মাতৃরূপেণ—৫, বঙ্গ-মননে পরিবার-সমন্বিতা দুর্গা দর্শন—রাধাবিনোদ ঠাকুর
- Get link
- X
- Other Apps
বঙ্গ-মননে পরিবার-সমন্বিতা দুর্গা দর্শন |
শ্রীনামব্রহ্ম শ্রীপাট। মদনপুর। নদীয়া।
বঙ্গ-বসুন্ধরায় শারদীয়া দুর্গাপুজোতে দুর্গা প্রতিমার যে কাঠামো দেখতে পাওয়া যায় , তাতে থাকে সাতটি মূর্ত্তি | সপ্তাহে সাতটি দিন | তার মধ্যেই জন্ম , মৃত্যু , প্রাপ্তি , অপ্রাপ্তি , সুখ , দু:খাদি সংঘটিত হয় | আমাদের জীবন-প্রবাহ সপ্তাহময় এবং সপ্তাহ জীবন-প্রবাহময় | দুর্গা প্রতিমার সপ্তমূর্ত্তি যেন সপ্তাহ-ক্রমবদ্ধ সময়ের কোলে আন্দোলিত সেই জীবন-প্রবাহেরই প্রতিফলন | যাকে বাঙ্গালী করে উদযাপন - উৎসবের আঙ্গিকে , আনুষ্ঠানিকতায় | এ যেন জীবনেরই উদযাপন , জীবন-যাপন | যা জীবন-ধারণের কনসেপ্টের থেকে স্বাভাবিক অর্থেই উন্নততর |
প্রতিমার কাঠামোতে মাঝে দেবী দুর্গা | তাঁর দক্ষিণে অপেক্ষাকৃত ওপরে লক্ষ্মী | একটু নীচে গণেশ | বামপার্শ্বে অনুরূপভাবে ওপরে সরস্বতী | নীচে কার্ত্তিকেয় | দেবীর পদতলে একদিকে সিংহ , অপরদিকে মহিষাসুর | দেবীর দক্ষিণ-পদ সিংহ-পৃষ্ঠে এবং বাম-পদাঙ্গুলী অসুরের স্কন্ধে ন্যস্ত | দেবীর আবাহন মন্ত্রে আছে -
"ওঁ দেবেশি ভক্তিসুলভে পরিবারসমন্বিতে |
যাবত্ত্বাং পূজয়িষ্যামি তাবত্ত্বং সুস্থিরা ভব ||"
অর্থাৎ , হে পরিবার-সমন্বিতা , ভক্তি-সুলভা , সুরশ্রেষ্ঠা দুর্গা , যতক্ষণ আমি তোমার পূজা করব , ততক্ষণ কৃপা করে স্থিরভাবে অবস্থান কর |
বাঙ্গালী মননে বঙ্গ-হৃদয়ে শারদীয়া দুর্গা দেবীর অধিষ্ঠান হয় কন্যা রূপে | কার্ত্তিকেয় , গণেশ প্রভৃতি দেবীর পরিবারভুক্ত | শরৎকালে বাংলার ঘরের মেয়ে উমা সপরিবারে তিন দিনের জন্য বাপের বাড়ীতে আগমন করেন | এই দেশের আগমনী সঙ্গীত এর সাক্ষ্য বহন করে চলেছে | যেখানে বঙ্গ-জননী মা-মেনকার আবেশে বলে ,---------
"এবার আমার উমা এলে
আর উমা'য় পাঠাব না |
আমায় বলে বলুক লোকে মন্দ
কারো কথা শুনবো না ||
যদি আসে মৃত্যুঞ্জয়-
উমা নেবার কথা কয় ,
মা'য়ে ঝি'য়ে করব ঝগড়া-
জামাই বলে মানব না ||
দ্বিজ রামপ্রসাদ কয়-
এ দু:খ কী প্রাণে সয় ,
শিব শ্মশানে-মশানে ফেরে
ঘরের ভাবনা ভাবে না ||
এ বার আমার উমা এলে
আর উমা'য় পাঠাব না ||"
(শ্রী রামপ্রসাদ ভট্টাচার্য্য ,
ঢাকা-চিনিশপুর) |
বাংলার প্রতিটি গৃহ যেন দেবীর পিত্রালয় | দেবী যেন প্রতিটি বাঙ্গালীর আদরের কন্যা | যার উদ্দেশ্যে বুকভরে "মা" ডেকে বাঙ্গালী বড় শান্তি পায় | এই ভাব-মথিত হৃদয়ে ধনদাত্রী লক্ষী , বিদ্যাদায়িনী সরস্বতী , শৌর্য্য-বীর্য্যের দ্যোতক কার্তিকেয় , সিদ্ধিদাতা গণেশ ও তাঁদের বাহনবর্গের মূর্ত্তিসহ সামগ্রিক দুর্গা-প্রতিমার ভাবনা ও আরাধনা বাঙ্গালীর স্বকীয়তা |
(১)
দুর্গা :-- "দুর্গা" শব্দটি নানার্থ বোধক | যিনি দুর্জ্ঞেয়া , অর্থাৎ যাঁকে জানা সহজ সাধ্য নয় | যিনি দূরধিগম্যা | পৌরুষের অভিমান , বল-বীর্য্য , জ্ঞান-বুদ্ধি কোনকিছুর দ্বারায় তিনি অধিগম্যা নন | তিনি যদি কৃপা করে নিজেকে জানান , তবেই তাঁকে জানা যায় | দুর্গা আদ্যা-শক্তি | তাই এখানে শক্তির সাপেক্ষহীনতা এবং স্বপ্রকাশতা ব্যক্ত হচ্ছে | শক্তি যেহেতু সর্বব্যাপিকা , সর্বত্র শক্তিরই খেলা , তাই শক্তি বাদ দিয়ে তো কিছু নেই , যা দিয়ে শক্তিকে জানা যেতে পারে | জানতে গেলে যা লাগবে , তাও তো শক্তিই | জ্ঞান-শক্তি | অতএব শক্তি দিয়েই শক্তিকে জানতে হবে , বুঝতে হবে | তাই শক্তির দ্বারাই বা কৃপাতেই শক্তিকে জানা সম্ভব | অন্য কোনও উপায় নেই | এই কারনেই তিনি দুর্জ্ঞেয়া বা দূরধিগম্যা | স্ব-প্রকাশে বা স্ব-কৃপাতে লোকমননে সুজ্ঞেয়া হন |
"দুর্গো দৈত্যে মহাবিঘ্নে ভববন্ধে চ কর্মণি |
শোকে দু:খে চ নরকে যমদন্ডে চ জন্মনি ||
মহাভয়ে অতিরোগেচাপ্যাশব্দ: অম্ভৃ বাচক: |
এতান্ হন্ত্যেব যা দেবী সা দুর্গা পরিকীর্ত্তিতা ||"
(ব্রহ্মবৈবর্ত্তপুরাণ,প্রকৃতিখন্ড/৫৩) |
'দুর্গ' শব্দে দৈত্য , মহাবিঘ্ন , ভববন্ধন , কর্ম , শোক , দু:খ , নরক , যমদন্ড , জন্ম , মহাভয় , অতিরোগ এবং 'আ' শব্দে হনন ----যিনি এই সকলকে হনন অর্থাৎ ছেদন করেন , তিনিই দুর্গা নামে অভিহিতা | জীবন পথে অগ্রগতির বাধা-বিঘ্ন , সংসারে ব্যবহারিক নানাপ্রকার বন্ধন , কর্মের তিক্ততা ও শ্রম-ফল প্রাপ্তির প্রতিবন্ধকতা , প্রিয়-বিচ্ছেদ-জাত শোক , অভিলসিত অপ্রাপ্তি জনিত দু:খ , জীবন-যন্ত্রণা ও অবসাদ রূপ নরক , কর্ম ফলের আঘাত রূপ যমদন্ড , জন্ম-কষ্ট(যে জন্ম দিচ্ছে , যে জন্মগ্রহণ করছে ও তার বলয়ের প্রিয়বর্গের মন:কষ্ট বা উদ্বেগ) , নানান ভীতির মূল মৃত্যুভয় , দূরারোগ্য ব্যাধি ইত্যাদি তো জীবনের অঙ্গ | জীবন থাকলেই এগুলো থাকবে | এই সব অতিক্রম করতে বা এই সমস্ত যন্ত্রণা রূপ বদ্ধ-দুর্গ থেকে মুক্তি পেতে যা যা লাগে , সেই সমস্তের মূলে রয়েছে মূলত: উদ্যম-শক্তি , বলীয়সি মানসিক-শক্তি ও অফুরন্ত প্রাণ-শক্তি | দেখুন , সবগুলোই শক্তি | যাকে 'আ' বাচক বলা হয়েছে | অর্থাৎ এই সমস্ত কিছু অতিক্রম করার শক্তি বা হনন করার শক্তি | এটিই দুর্গা-বিজ্ঞান |
শাস্ত্রবচনে রয়েছে ,
"দৈত্যনাশার্থবচনো দকার: পরিকীর্ত্তিত: |
উকারো বিঘ্ননাশস্য বাচকো বেদসম্মত: ||
রেফো রোগঘ্নবচনো গশ্চ পাপঘ্নবাচক: |
ভয়শত্রুঘ্নবচনশ্চাকার: পরিকার্ত্তিত: ||"
অর্থাৎ , 'দ' অক্ষর দৈত্যনাশক | 'উ' কার বিঘ্নবিনাশক | 'রেফ্' রোগনাশক | 'গ' কার পাপনাশক এবং 'আ' কার ভয়-শত্রুনাশক | দৈত্য , বিঘ্ন , রোগ , ভয় এবং পাপ রূপ শত্রুর থেকে যিনি রক্ষা করেন , তিনিই দুর্গা | 'দ' মানে দৈন্য-বোধিকা শক্তি | আবার 'দ' অর্থাৎ দম্ভ | যা দৈত্যের মতোই সর্ব্বগ্রাসী | আমাদের জীবনের নমনীয়তা , শিক্ষা , সংস্কার সব গ্রাস করে আমাদের উদ্ধত তথা উচ্ছৃঙ্খল করে | এটা একপ্রকার মদ বা মত্ততা | কোন গুরুজ্ঞান থাকেনা | এই কারনে শাস্ত্রে অভিমানকে সুরাপানের সঙ্গে তুলনা করা হয়েছে | "অভিমানং সুরাপানম্" | যা পক্ষান্তরে ধ্বংসের পথকেই প্রশস্ত করে | এই জন্যেই বলা হয়েছে , দম্ভ বা অহংকারের মতো বড় শত্রু নাই--'নাহংকারাৎ পরোরিপু:' | জগজ্জননী শরণাগতের প্রাণে বিদ্যার সার বিনয় জাগিয়ে এই দম্ভ-দৈত্যকে নিধন করেন | যার মূলে থাকে দৈন্য-বোধিকা শক্তির উদ্বোধন | 'উ' অর্থাৎ বিঘ্নবিনাশিকা শক্তি | ঊর্জ্জা | তেজস্বীতা | প্রবল মনোবল | আবার 'উ' মানে উদ্ভ্রান্তি | যা মন:-বিক্ষেপ থেকে আসে | যাকে অমনোযোগিতা বা অন্যমনস্কতাও বলা চলে | যা কর্মক্ষেত্রে ভ্রান্তি উৎপন্ন করে | আর ভ্রান্তি কর্ম-প্রাঙ্গণে অবাঞ্ছিত বিঘ্ন বৈ কি | পরিস্থিতির অনুকূল প্রবল মনোবল জাত একাগ্রতা-শক্তি জাগিয়ে মা এই ভ্রান্তি-বিঘ্ন থেকে আমাদের উদ্ধার করেন | যার মূলে থাকে ঊর্জ্জা-শক্তির ক্রিয়া | 'রেফ্' রোগ-নাশিকা শক্তি | অসংযমী জীবন যাপন রোগের কারন | জীববৎসলা মা আশ্রিতের জীবনে সংযম শক্তি জাগিয়ে দেহ ও মন নির্মল করেন | ক্রমে রোগপ্রতিরোধিকা-শক্তি এবং প্রাণ-শক্তি বাড়ে | যাতে দেহ-রোগ--ব্যাধি এবং মনোরোগ--আধি নাশ প্রাপ্ত হয় | এখানে মা "সর্ব্বরোগবিনাশিনী" | 'গ' অঘ-নাশিকা শক্তি | অঘ মানে পাপ | লাগাম ছাড়া লোভ-লালসা থেকেই পাপ-প্রবৃত্তি জাগে | যা অন্ধকারময় | তাই একে 'গু' বলাহয় | আর 'রু' হল আলো -"গু-শব্দস্ত্বন্ধকারস্যাৎ রু-শব্দস্তন্নিরাসক:" | পাপান্ধকার থেকে তুলে ধরেন যিনি জ্ঞানের আলো জ্বেলে , তিনিই তো 'গুরু' | জীবনে আদর্শ-গুরু রূপে ধরা দিয়ে চিত্তে জমে থাকা জন্মজন্মান্তরের পাপ-প্রবৃত্তির সংহার করেন গুরুরূপা মা | 'আ' হল ভয়নাশিকা-শক্তি | আবার 'আ' মানে আবেশ বা অভিনিবেশ | শ্রুতি বলেন , "ভয়ং দ্বিতীয়াভিনিবেশত:" | অর্থাৎ , ভয় হয় দ্বিতীয় বস্তুতে অভিনিবেশ থেকে | দ্বিতীয় শব্দটি সাপেক্ষ শব্দ | প্রথম না হলে দ্বিতীয় হয় না | তাহলে , প্রথম বস্তু কী ? প্রথম বস্তু হল আত্মা | আর দ্বিতীয় বস্তু হল দেহ | দেহতে যতখানি অভিনিবেশ , ভয়ও ততোধিক | মা পরমকরুণায় জীবনে সাধন-সঞ্চার করে আবেশ বা নিবেশ দেহের থেকে আত্মাতে স্থিত করেন | তখন আপনা হতেই সব ভয় অপসারিত হয় | এখানে মা অভয়া , অভয়দা |
আবার যিনি 'দুর্গ' নামক অসুরকে নাশ করেন তিনিই নিত্য দুর্গা নামে প্রকৃষ্টরূপে কীর্ত্তিতা হন --"দুর্গং নাশয়তি যা নিত্যং সা দুর্গা বা প্রকীর্ত্তিতা |"(শব্দকল্পদ্রুম,৩/১৬৬৬) | আমাদের জীবনে আমরাই সুকর্ম অথবা দুস্কর্মের দুর্গ রচনা করি | যার জের , সংস্কার হয়ে জন্ম-জন্মান্তর ধরে আমাদের বন্ধনের কারন হতে থাকে | নিজকৃত সেই দুর্গের ভেতরে নিজেই কখন বন্দি হয়ে পড়ি , বুঝতেও পারি না | "আমি স্বখাত সলিলে ডুবে মরি শ্যামা , দোষ কারো নয়'গো মা" (শ্রী দাশরথি রায়) | এই বন্দির দুর্দশা থেকে উদ্ধার করবে কে ? তিনি একমাত্র মহাশক্তি | যিনি ত্রিলোক উদ্ধারের হেতু বা কারন | যুগে-যুগে , কল্পে-কল্পে , সময়ে-সময়ে তাঁর দ্বারায় এই উদ্ধার কার্য্য সাধিত হয়ে থাকে | আবদ্ধ ব্যক্তিকে মুক্ত করতে যে প্রবল সামর্থ্য বা শক্তির প্রয়োজন , তা তো তিনিই বা তাঁরই পরিনতি | পক্ষান্তরে একে করুণা-শক্তি বা কৃপা-শক্তিও বলা যায় | তা সে সংসার-জটিলতার থেকে মুক্তি হোক বা ভববন্ধন থেকেই চিরমুক্তি হোক | এইজন্যেই দুর্গাপূজার নবপত্রিকা প্রবেশ-মন্ত্রে উদ্ঘোষিত হয়---"ত্রৈলোক্যোদ্ধারহেতুস্ত্বং অবতীর্ণা যুগে যুগে |"
শ্রীশ্রীচন্ডীতে রয়েছে , দুর্গম নামক অসুরকে বধ করে মায়ের নাম দুর্গা | দুর্গম-অসুরের কাজ হল জীবকে দুর্গতি দেওয়া | দুর্গমকে বধ করে যিনি জীবজগৎকে অশেষ দুর্গতির হাত থেকে অব্যাহতি দেন , তিনি মা দুর্গা | তাই ভ্রষ্ট-রাজ্য যুধিষ্ঠির অসহনীয় দুর্গতি থেকে মুক্ত হবার জন্য মহাভারতের বিরাটপর্ব্বের ষষ্ঠ অধ্যায়ে দুর্গাদেবীর স্তোত্রে বলছেন , "দুর্গাৎ তারয়সে দুর্গে তৎ ত্বং দুর্গা স্মৃতা জনৈ: |" দুর্গমাসুরের দুইটি রূপ | সংসার পথে এই অসুরের নাম স্বার্থান্ধতা এবং আধ্যাত্মিক পথে এই অসুরের নাম অবিদ্যা | দুর্গম স্বার্থান্ধতায় মজে জীব অশেষ দুর্গতি ভোগ করে | তা থেকে মা রক্ষা করেন লোক-কল্যাণ-ময়ী বুদ্ধি বৃত্তি জাগ্রত করে | দুর্গম অবিদ্যার অধীন হয়ে জীব দু:খে জর্জরিত হয় মায়ার খাদে পড়ে | তা থেকে সন্তানকে বাঁচান মা জ্ঞান -অসি দ্বারা অবিদ্যা-বন্ধন ছেদন করে | জীবের চরম দুর্গতি হয় তখনই , যখন সে রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে হয় বিচ্যুত | মহাশক্তি মহামায়া ভগবতী দুর্গা হলেন রাষ্ট্রাধিশ্বরী | ঋগ্বেদের দেবী-সূক্তের-"অহং রাষ্ট্রী সংগমনী বসূনাম্ / চিকিতুষী প্রথমা যজ্ঞিয়ানাম্ "-এই মন্ত্রাংশটি এর সাক্ষ্য প্রদান করছে | স্থূলভাবে দেখতে গেলে এই কথাটির অর্থ হল--'আমি রাষ্ট্রের অধিশ্বরী , আমারই অনুগ্রহে যজমান অর্থ লাভ করে থাকে |' কিন্তু এর তাৎপর্য্য সুদূরপ্রসারী | পারত্রিক অভ্যুদয়ের মূলে রয়েছে যাগ-যজ্ঞের অনুষ্ঠান , যা অর্থ ছাড়া সম্ভবপর নয় | জাগতিক অভ্যুদয়ের মূলেও রয়েছে অর্থ | কিন্তু রাষ্ট্রচ্যুত হলে অর্থপ্রাপ্তি এবং প্রাপ্ত অর্থের রক্ষণ পদে পদে বিঘ্নিত হতে থাকে | মহিষাসুরের দ্বারা রাষ্ট্রীয় অধিকার থেকে ভ্রষ্ট হয়ে দেবগণের যে কী জাতীয় দুর্দ্দশা হয়েছিল তার বিবরণ আমরা মার্কন্ডেয় পুরাণান্তর্গত দেবীমাহাত্ম্যাত্মক 'শ্রীশ্রীচণ্ডী' গ্রন্থে দেখতে পাই | কিন্তু পরাজিতবর্গ যদি নিজেদের তেজ ও ত্যাগের ভিত্তিতে সুপ্রতিষ্ঠিত হয়ে আততায়ীর বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধভাবে ফিরে দাঁড়ায় , তখন এই সম্মিলিত শক্তির কাছে আসুরী শক্তি তিষ্ঠিতে পারে না | দেববৃন্দ মহিষাসুরের দ্বারা নিপীড়িত হয়ে সংঘবদ্ধভাবে তার বিরুদ্ধে ফিরে দাঁড়িয়ে ছিল | এর ফলে তাঁদের তেজোরাশি থেকে এক দেবীমূর্ত্তি আবির্ভূতা হলেন , ইনিই মহিষমর্দ্দিনী | দেবগণ তাঁদের শক্তিরূপিনী এই দেবীকে স্ব স্ব ভূষণ ও আয়ুধ প্রদান করে সজ্জিত করে দিলেন | এই কাজের মধ্যেদিয়ে প্রকাশ পাচ্ছে তাঁদের অসামান্য ত্যাগের নিদর্শন | এই দেবীর দ্বারা মহিষাসুর নিহত হল | সংক্ষেপে বলতে গেলে মহিষমর্দ্দিনীর আবির্ভাবের মূলে রয়েছে প্রবল পরাক্রান্ত আততায়ীর বিরুদ্ধে প্রপীড়িতগণের সংঘবদ্ধ অভিযান | যার মূল প্রেরণাদায়ী শক্তি মা দুর্গা | তিনিই জনগণের সংঘবদ্ধ শক্তি | বিপ্লব-শক্তি | বাস্তবের মাটিতে ব্যক্তি-জীবনে , সমষ্টি-জীবনে , জাতি তথা রাষ্ট্র-জীবনে যার ক্রমবিকাশ শিক্ষা , চেতনা , বিপ্লব এবং মুক্তির মধ্যে দিয়ে লক্ষ্য করা যায় |
বেদভাষ্যকার সায়নাচার্য্য বলেন যে , ঋগ্বেদের দশম-মন্ডলের ১২৫ সংখ্যক সূক্তে অম্ভৃণ-কন্যা ব্রহ্মবিদুষী 'বাক্' নিজে পরাশক্তির সঙ্গে একাত্মতা অনুভব করে আত্মস্বরূপ সেই পরাশক্তির স্তুতি করেছেন | তার নাম 'দেবীসূক্ত' | তার সপ্তম-মন্ত্রে আছে , "অহং সুবে পিতরমস্য মূর্দ্ধন্ / মম যোনিরপ্স্বন্ত:সমুদ্রে | ততো বিতিষ্ঠে ভুবনানু বিশ্বো / তামূং দ্যাং বর্ষ্মণোপস্পৃশামি ||" এর অর্থ , 'সর্ব্বোপরি যে জগতের পিতা , তাঁকেও আমি প্রসব করেছি | পরমজ্ঞান-সমুদ্রের অভ্যন্তরে আমার যোনিস্থান | সর্ব্বভুবনে আমি অনুপ্রবিষ্ট | ভূলোকের ঊর্দ্ধে যে দ্যুলোক আছে , তাও স্থির আছে আমি স্পর্শ করে আছি বলে |' সুতরাং মূলশক্তির থেকেই নিখিলের প্রকাশ এবং বিকাশ | তিনি বিশ্ব-প্রসবিতা | স্নেহময়ী জননী | তাঁর নয়ন থেকে সতত করুণামৃতধারা নির্ঝরিত -"মায়ের স্নেহ-চক্ষে প্রেম-বক্ষে অমিয় ঝরে |" রণে তিনি যখন ভীষণা তখনও তাঁর চিত্ত কৃপা-পূর্ণ -"চিত্তে কৃপা সমর-নিষ্ঠুরতা চ দৃষ্টা |"(শ্রীশ্রীচন্ডী,২/২২) | হৃদয়ে মুক্তিপ্রদ কৃপা আর সমরে মৃত্যপ্রদ কঠোরতা | এই জন্যেই দুর্গা-ধ্যানমন্ত্রে দেখতে পাই , যখন তিনি সমরাঙ্গনে শত্রুক্ষয় করছেন , তখনও তাঁর বদন প্রসন্ন ও তিনি সন্তানের সব কামনার ফলদানকারিনী----
"শত্রুক্ষয়করিং দেবীং দৈত্যদানবদর্পহাম্ |
প্রসন্নবদনাং দেবীং সর্ব্বকামফলপ্রদাম্ ||"
মায়ের এই দুই ভাবের সমন্বিত চেতনার মধ্যেই সৃষ্টি ও সংহারের বীজ লুক্কায়িত | যা নিরন্তর মৌহূর্ত্তিক ভাবে সংঘটিত হয়ে চলেছে জড়ে ও চেতনে |
সন্তানের জন্যেই মায়ের অসুরের সঙ্গে যুদ্ধ | কিন্তু তিনি যখন বিশ্ব-প্রসবিতা , তখন অসুরগণ কী বিশ্ব ছাড়া ? তিনিতো অসুরদেরও মা | তাহলে এক সন্তানকে রাখছেন , আরেক সন্তানকে মারছেন কেন ? এর উত্তর সহজ | কারো দেহের কোনও অংশে যদি পচন ধরে তাহলে অভিজ্ঞ চিকিৎসক অস্ত্রোপচার করে সেই দেহ বাদ দেন | এটি চিকিৎসা-বিজ্ঞানের এক পরিস্থিতি-সাপেক্ষ অবধারিত পদ্ধতি | এর মানে , চিকিৎসক সেই রোগীর ক্ষতি করলেন না , বরঞ্চ তার অঙ্গচ্ছেদ করে তাকে নির্ধারিত মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষাই করলেন | নইলে সেই পচন সর্বাঙ্গে ছড়াতো ও রোগীটির মৃত্যুই ঘটত | ঠিক তেমনি , অশুভ-বৃত্তি সম্পন্ন অসুরগণ সমাজ-শরীরের পচে যাওয়া অঙ্গ | মা অসুর-সংশোধনার্থে প্রথমে বাক্য প্রয়োগ করে সৎ-প্রেরণায় তাদেরকে প্রাণিত করতে চান | কিন্তু তার ফল হয় উল্টো | অসুরগণ তাদের স্বভাবসিদ্ধ প্রবৃত্তিতে এটি মা'র দুর্বলতা ভেবে মাকেই ভোগ করতে উদ্যত হয় | তখন গত্যন্তর না দেখে ইন্দ্রিয়-মন বিশিষ্ট অসুরদের ঐ বিকারগ্রস্ত পাঞ্চভৌতিক দেহকেই মা বিনষ্ট করেন | এতে সমাজ-কলেবর রোগমুক্ত হয় ও সমাজস্থিত শিষ্টগণ শান্তি প্রাপ্ত হন | যা জগতে প্রামাণিক ভাবে শুভশক্তির প্রচার-প্রসারের ক্ষেত্রে সহযোগী হয় | ধ্বংস হয় অসুর-দেহের | কিন্তু অবিনাশী আত্মা অভিন্ন-পরমাত্মা মহাশক্তিতে বিলীন বা সম্মিলিত হয়ে বিমুক্ত হয়ে যায় | যাঁদের রক্ষা করে পালন করতে মায়ের অসুরদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে হয় , তাঁদেরও আগে অসুরগণকে উদ্ধার করেন জীববৎসলা মা | এতেই তাঁর সর্বাধিক করুণার প্রকাশ | আর রণ-নিষ্ঠুরতা তো করুণা প্রকাশের প্রক্রিয়া মাত্র | অসুরেরা যে পরিমান পাপকার্য্য করে , তাতে তাদের বিচার যদি যমরাজের বিধিমত হয় , তাহলে তাদের কোটি কোটি কল্প কাল নরক যন্ত্রণা ভোগ করতে হয় | কিন্তু জগজ্জননীর শস্ত্র স্পর্শে পূত হয়ে তারা পরমাগতি লাভ করে | মা'র চিত্তে কৃপা আছে বলেই অসুরদের পক্ষে এতক্ষণ মা'রই দেওয়া শক্তিতে মা'র বিরুদ্ধে যুদ্ধ করা সম্ভব হয়ে থাকে | এ যেন মায়ের রণ-রসাস্বাদনের খেলা |
মায়ের দশটি বাহু | দশ(১০) সংখ্যার মধ্যে আছে এক(১) এবং শূন্য(০) | সংখ্যাতত্ত্বে প্রথমে অব্যক্ত রূপে শূন্যের(০) অস্তিত্ব | তারপর এক(১) , দুই(২) , তিন(৩) , চার(৪) , পাঁচ(৫) , ছয়(৬) , সাত(৭) , আট(৮) , নয়(৯) যুক্ত হলে তারপর দশ(১০) | দশ(১০) সংখ্যায় একের(১) পর আবার সেই শূন্য(০) | তাৎপর্য্য হল , সৃষ্টির আদিতে অব্যক্ত-শক্তি রূপে শক্তি ছিল শূন্যের(০) মতো | সেই শক্তি বিক্ষুব্ধ হলে জগত রূপেতে পরিণামিত বা ব্যক্ত হতে থাকল ঠিক এক(১) থেকে পর পর নয়ের(৯) মতো | আবার ব্যক্ত জগত লয় প্রাপ্ত হলে সেই অব্যক্ত শক্তিই অবশিষ্ট থাকে ঠিক দশ(১০) সংখ্যায় একের(১) পরে শূন্যের(০) মত | অর্থাৎ আদিতেও অব্যক্ত শক্তি , সৃষ্ট্যাদি কর্মের মধ্যেও সেই শক্তিরই ক্রিয়ান্বয়ন , আবার লয়ের পরেও শক্তিরই অস্তিত্ত্ব | আদিতেও শক্তি , মধ্যেও শক্তি এবং অন্তেও শক্তি-
"বিসৃষ্টৌ সৃষ্টিরূপা ত্বং স্থিতিরূপা চ পালনে |
তথা সংহৃতিরূপান্তে জগত: অস্য জগন্ময়ে ||"
(শ্রীশ্রীচন্ডী,১/৭৬) |
এই মর্ম্মই যেন অভিব্যক্ত হচ্ছে দুর্গার দশ হাতে | দিক দশটি | পূর্ব , পশ্চিম , উত্তর , দক্ষিণ , ঈশাণ , অগ্নি , নৈঋত , বায়ু , উর্দ্ধ এবং অধ: | এই দশ দিকেই দেবীর ব্যাপ্তি | মহাশক্তি সর্ব্বব্যাপিকা | দশ দিক থেকে দশ হাতে দেবী তাঁর সন্তানবর্গকে রক্ষা করেন | দশ সংখ্যাটি অসংখ্যের দ্যোতক | আমরা প্রচলিত কথায় বলি , 'দশ জনে কী বলবে' বা 'দশ জনের মাঝে বলা ভাল' ইত্যাদি | এসব ক্ষেত্রে দশ মানে শুধুমাত্র গুনে গুনে দশ জনই নয় | অপিতু অনেক | অসংখ্য | মায়ের অসংখ্য বাহু | মায়ের বাহুতে পালনী শক্তি | যেখানে যেখানে পালনী শক্তির বিকাশ সেখানে সেখানেই মায়ের বাহুর ক্রিয়া | মা অসংখ্য বাহু দ্বারা অসংখ্য সন্তানকে প্রতিপালন করেন নিরন্তর | দশ ভুজে মা দশপ্রহরণধারিনী | দশ হাতে মায়ের দশ অস্ত্র | যথা দুর্গা-ধ্যানমন্ত্রে- ,
"ত্রিশূলং দক্ষিণে ধ্যেয়ং খড়্গং চক্রং ক্রমাদধ: ||
তীক্ষ্ণবাণং তথাশক্তিং দক্ষিণেষু বিচিন্তয়েৎ ||
খেটকং পূর্ণচাপঞ্চ পাশমঙ্কুশমেব চ |
ঘন্টাং বা পরশুং বাপি বামত: সন্নিবেশয়েৎ ||"
অর্থাৎ , মায়ের ডানদিকের পাঁচ হাতের অস্ত্রগুলি ওপর থেকে নীচের দিকে যথাক্রমে ত্রিশূল , খড়্গ , চক্র , তীক্ষ্ণ-বাণ ও শক্তি | বাম দিকের পাঁচ হাতের অস্ত্রগুলি একই ক্রমে খেটক(ঢাল) , ধনু , পাশ , অঙ্কুশ ও ঘন্টা বা পরশু অর্থাৎ কুঠার/ফারসা | অস্ত্রগুলি প্রত্যেকটি আধ্যাত্মিক অর্থবাহী | যেমন 'ত্রিশূল' | তিনটি শূল দ্বারা জীবের স্থূল , সূক্ষ্ম ও কারণ এই তিন দেহ লয় করে সিদ্ধ দেহ জাগিয়ে দেন | ত্রিশূলের তিনটি ফলা অতীত , বর্তমান ও ভবিষ্যতের দ্যোতক | তারমধ্যে মাঝের ফলাটি একটু বেশী উঁচু | তাৎপর্য্য , অতীতে যা হয়েছে তা তো হয়েই গিয়েছে , বর্তমানটা গুরুত্ত্বপূর্ণ | তাই উঁচু | কিংবা , বর্তমানে উঁচু অর্থাৎ শ্রেষ্ঠ কর্ম সম্পাদন করলে ভবিষ্যৎ সুখকর হবে | ত্রিশূলের তিনটি ফলা সৃষ্টি-স্থিতি এবং লয়কেও জ্ঞাপিত করে | সূচিত করে জল , স্থল ও অন্তরিক্ষ শক্তিরই ক্রীড়াঙ্গন | 'খড়্গ' অর্থে তত্ত্ব-জ্ঞানের অসি | যার দ্বারা অজ্ঞানতা রূপ বৃক্ষের মূলচ্ছেদ করেন | খড়্গে চোখ আঁকা থাকে | তার মানে জ্ঞান-অসি চক্ষুষ্মান | সব দেখছে | কোথায় জ্ঞান , কোথায় অজ্ঞানতা | দেখে শুনে বিচার করে অজ্ঞান-জাড্যকে ছেদন করছে এবং নিজের মতোই জ্ঞান-চক্ষু জাগিয়ে দিচ্ছে | বিষ্ণু বা কৃষ্ণের মতো মায়ের হাতেও 'চক্র' | চক্র কাল-চক্রের পরিচায়ক | কাল বা সময়কে স্বহস্তাঙ্গুলিতে নিয়ন্ত্রণে রেখেছেন মা , তার গতির সদ্ব্যবহার করে | সময়ের গতিকে উপলব্ধি করে সময়ানুকূল কার্যসাধনই জীবনকে শোভিত করে , সুন্দর করে , করে সুষমামন্ডিত | তাই চক্রের নাম সু-দর্শন | আর এটাই সুন্দর এবং উন্নত দর্শন | তাই সু-দর্শন | এই কালরূপ চক্রে আমাদের জীবনচক্রও বিঘূর্ণিত | যা জন্ম-মরণাদি ক্রমে আমাদেরকে কর্মফল ভোগ করায় | ভাল ছেলের মতো মায়ের চরণে প্রপন্ন হতে পারলেই মা করুণা করে তার থেকে নিষ্কৃতি দেবেন | সময়ই তো আমাদেরকে মারে ও রাখে | কখনও সুসময় , কখনও দু:সময় | এটিই চক্রের আদর এবং আঘাত | যা মায়ের হাতে | মায়ের বাধ্য সন্তান হতে পারলে আর ভয় থাকেনা | 'তীক্ষ্ণ-বাণ' মানে ধারাল তীর | ধনুক থেকে তীর ছোঁড়া হয় নির্দিষ্ট লক্ষ্যে | তীর লক্ষ্য ভেদ করে | সেই রকম সংসার থেকেই লক্ষ্য স্থির করে আমাদেরকে মাতৃপদে আত্মনিক্ষেপ করতে হবে | ধারাল তীরের অগ্রভাগ খুবই তীক্ষ্ণ | তেমনই সুতীক্ষ্ণ বিচার চাই জীবনে | সূক্ষ্ম-বিবেচনা চাই | তবেই তো হবে প্রকৃত কল্যাণ | এইরকম প্রতিটি আয়ুধের ব্যবহারিক ও পারমার্থিক তাৎপর্য্য আছে |
ধ্যানমন্ত্রে বর্ণিত আছে , ত্রিভঙ্গ ভঙ্গিমায় দাঁড়িয়ে আছেন মা দুর্গা , ঠিক শ্রীকৃষ্ণের মতো--"ত্রিভঙ্গ-স্থান-সংস্থানাং"(মার্কন্ডেয়-পুরাণ) | মায়ের বামচরণ , কটি ও গ্রীবা ঈষৎ ভঙ্গিম | দক্ষিণচরণ রেখেছেন সিংহপৃষ্ঠে সোজা ভাবে--"দেব্যাস্তু দক্ষিণং পাদং সমং সিংহোপরি স্থিতম্ |" বামচরণের অঙ্গুষ্ঠ রেখেছেন অসুরের স্কন্ধোপরি--"কিঞ্চিদূর্ধ্বং তথা বামমঙ্গুষ্ঠং মহিষোপরি |" শ্রীশ্রীগীতা-মুখে ভগবান শ্রীকৃষ্ণ "যদা যদাহি ধর্মস্য গ্লানির্ভবতি ভারত....." মন্ত্রে যা বলতে চেয়েছেন , শ্রীশ্রীচন্ডীতে দেববৃন্দ সমক্ষে ভগবতী দুর্গা "যদা যদা বাধা দানবোথ্যা ভবিষ্যতি..." মন্ত্রে ঠিক একই কথা বলেছেন | কথার মর্ম্ম হল , যখনই যখনই ধর্ম বিঘ্নিত হয় ও অধর্মের অভ্যুত্থান হয় , তখনই তখনই শিষ্টের পালন , দুষ্টের দমনে তাঁর আবির্ভাব হয়ে থাকে | এই শক্তিকে লক্ষ্য করেই বৈষ্ণবাচার্য্য শ্রীজীব গোস্বামিপাদ "শ্রীভগবৎ-সন্দর্ভ"-এ "গৌতমীয়-কল্প"-এর বচন উদ্ধৃত করেছেন , "য: কৃষ্ণ সৈব দুর্গা স্যাৎ / যা দুর্গা কৃষ্ণ এব স: |"
(২)
সিংহ :- দেবীর বাহন সিংহ | হিংস ধাতু থেকে সিংহ শব্দের নিস্পত্তি | অর্থাৎ যে হিংসা করে , সেই সিংহ | হিংসা করা রজোগুণের কাজ | তাই সিংহ রজোগুণকে সূচিত করে | লক্ষণীয় বিষয় , রজোগুণের মধ্যে রয়েছে প্রচুরতর শক্তির উচ্ছ্বাস | সত্ত্বগুণের অনুগত হলে সেই শক্তি লোকস্থিতির সহায়ক হয়ে ওঠে | বিশুদ্ধসত্ত্বের পরিণতি দেবী মহাময়া অশুভ শক্তি-পরিচায়ক অসুরের বিরুদ্ধে রজোগুণের প্রতীক সিংহকে স্বীয় পক্ষে রেখেছেন নিজ নিয়ন্ত্রণাধীনে | এখানে সিংহ আসুরিকতা ও পাশবিকতার উচ্ছেদ সাধন পূর্বক কল্যাণেশ্বরী দেবীর লোকস্থিতিমূলক কল্যাণ-কর্মের সহায়কারী | মহাদেবীর মহাপূজায় মহাশক্তি অর্জন আমাদের পরম কাম্য | কিন্তু সত্ত্বগুণের অনুশীলনে রজোগুণীয় শক্তি-উচ্ছ্বাসকে কল্যাণমুখী করতে হবে | নইলে স্বতন্ত্র রজোগুণের শক্তি অহংকার আর স্বার্থান্ধতা নিয়ে আসবে | যা হবে শক্তি-উচ্ছ্বাসের অপব্যবহার এবং ফলত: সার্বিক মঙ্গলের চরমতম প্রতিবন্ধক | তাই , রজোগুণকে কিভাবে সত্ত্বগুণের অনুগত রাখতে হবে , তা মা দুর্গা নিজ পদতলে অনুগত বাহন রূপে সিংহকে রেখে জগজ্জীবকে শিক্ষা দিচ্ছেন|
আর একটি দিকও আছে | প্রত্যেক মানুষের ভেতরে একটা পশু লুকিয়ে থাকে | যাকে বলে পশুভাব | সময় এবং পরিস্থিতি সাপেক্ষে তার প্রকাশ হয় | পুরুষকার , শরণাগতি ও সাধন-ভজনের দ্বারা মানুষ যখন যথার্থ মনুষ্যত্বে উন্নীত হয় , তখন তার পশুভাব কেটে যায় ও দেবভাবের জাগৃতি ঘটে | যা সমষ্টি-কল্যাণে নিয়োজিত হয়ে জীবনকে সার্থক করে তোলে | দেবীর চরণতলে পশুরাজ সিংহ সেই ভাবেরই প্রতীক |(৩)
অসুর :- দেবীর সম্মুখে বামদিকে অসুরের অবস্থান | অসুর শব্দের প্রাচীন অর্থ ছিল , যে প্রাণশক্তি রক্ষা করে বা যার মধ্যে প্রাণ শক্তির প্রাচুর্য্য থাকে ('আসু-প্রাণ') | অসুর মানে সুর-বিরোধী | দৈবীশক্তির সঙ্গে আসুরী শক্তির সংগ্রাম চিরকালীন | এই সংগ্রাম বাইরে- সমাজে , রাষ্ট্রে , বৈশ্বিক ক্ষেত্রে যেমন অনবরত চলছে , সেরূপ চলছে অন্তরেও | সাধকের সাধন-প্রাঙ্গনেও এই সংগ্রাম বিদ্যমান | সুতরাং অসুর মানুষের প্রবহমান জীবনের প্রতীক | দম্ভ , দর্প , অভিমান , ক্রোধ , নিষ্ঠুরতা ও অজ্ঞানতা---এ গুলি আসুরী সম্পদ--
"দম্ভো দর্প: অভিমানশ্চ ক্রোধ: পারুষ্যমেব চ |
অজ্ঞানং চাভিজাতস্য পার্থ সম্পদমাসুরীম্ ||"
(শ্রীগীতা,১৬/৪) |
অপরপক্ষে নির্ভীকতা , শুদ্ধ ব্যবহার , জ্ঞান-যোগনিষ্ঠা , দান , বাহ্যেন্দ্রিয়ের সংযম , যজ্ঞ , বেদপাঠ , তপস্যা , সরলতা , অহিংসা , সত্য , ক্রোধহীনতা , ত্যাগ , শান্তি , অদোষদর্শিতা , জীবপ্রীতি , লোভরাহিত্য , মৃদুতা , অসৎ চিন্তা ও কর্মে লজ্জা , অচপলতা , তেজ , ক্ষমা , ধৈর্য্য , পবিত্রতা , দ্বেষশূন্যতা , নিরভিমানতা---এগুলি দৈবী সম্পদ (শ্রীগীতা,১৬/১-৩) | সর্বপ্রকার উন্নতি ও কল্যাণের পথে আসুরিক ভাব অন্তরায় , অগ্রগতির প্রতিবন্ধক | আসুরী ভাব সমূহের প্রতিমূর্ত্তি অসুর | তার প্রাণশক্তি প্রচুর , কিন্তু তা অসৎ পথে চালিত | তাই তাকে শুভপথে আনবার জন্য , দৈবী সম্পদের অধিকারী করবার জন্য মায়ের এত প্রযত্ন |
সাধকের পক্ষে অসুর অবিদ্যা | পরাবিদ্যারূপিণী মা অবিদ্যা বিনাশ করে মহামুক্তি বিধান করেন | সাধারণ মানুষের জীবনে দু:খ , কষ্ট , ভয় , ভীতি , আপদ , বিপদ সবই আসুরিক শক্তির এক এক ক্রিয়া | পরমকরুণাময়ী মা সন্তানের জন্য কত ব্যস্ত | নিরন্তর অসুর বিনাশ করে সন্তানের কল্যাণ বিধান করছেন | সন্তানরক্ষায় চিরবিজয়িনী অপরাজিতা মা দুর্গার পাদপদ্মে প্রণত হয়ে আমরা প্রার্থনা করি---মা অসুর বিনাশ কর | আসুরিক ভাব নাশ কর | আমাদের মধ্যে দৈবী ভাব জাগ্রত কর |
(৪)
লক্ষ্মী :- লক্ষ্মী বিকাশ বা অভ্যুদয়ের প্রতীক | বিকশিত হওয়ার নাম বিকাশ | সূর্য্যোদয়ে কমল বিকশিত হয় | তেমনি সততা-সূর্য্যোদয়ে সৌভাগ্য বিকশিত হয় | সৌভাগ্য লক্ষ্মী | তা কমলের মতো বিকশিত হয় | তাই লক্ষ্মীর আরেক নাম কমলা | ধন , জ্ঞান এবং শীল----তিনেরই সামগ্রিক বিকাশ লক্ষ্মীর চরিত্রমাহাত্ম্যে | সর্বাত্মক বিকাশের প্রস্ফুটিত প্রসন্না স্বরূপ তাঁর , এই জন্যেও তিনি সুপ্রসন্না কমলা | কমলের মতোই নির্মল ও স্নিগ্ধ সৌন্দর্য্য তাঁর | নেত্রদ্বয়ও পদ্মের ন্যায় আয়ত | তাই তো তাঁর শুভ-করে প্রস্ফুটিত পদ্ম | আবার "যত্র পদ্মবনানি চ তত্র সন্নিহিতো হরি:" অর্থাৎ--যেখানে পদ্মবন সেখানে হরি নিবাস করেন , বলেই কমলার কমলবনেই বসতি |
পুরাণানুসারে লক্ষ্মী সমুদ্রোদ্ভবা | সমুদ্র-মন্থনে তাঁর উৎপত্তি | সমুদ্র রত্নাকর | রত্ন মূল্যবান সম্পদ | অতএব তাও লক্ষ্মী | মনোযোগে মন্থন করলে রত্ন অবশ্যই মেলে | বিশ্বপ্রকৃতিও একটি সমুদ্র | যাঁরা বিচক্ষণ তাঁরা ভূমি-প্রকৃতি কর্ষণ করে শস্য-লক্ষ্মী ঘরে তোলেন | বন-প্রকৃতি অনুসন্ধান করে ধন-লক্ষ্মী সংগ্রহ করেন | খনি-প্রকৃতি খনন করে স্বর্ণ-লক্ষ্মী উত্তোলন করেন | এ সবই সাগর-মন্থনে ধনাধিষ্ঠাত্রী লক্ষ্মীর আবির্ভাব | সবই লক্ষ্মীর আরাধনা |
কেবল টাকাকড়িই ধন নয় | চরিত্রধন মহাধন | যার টাকাকড়ি নেই সে যেমন লক্ষ্মীহীন | যার চরিত্রধন নেই সেও তেমনি লক্ষ্মীছাড়া | যাঁরা সাধক তাঁদের কাছে শ্রেষ্ঠ সম্পদ মুক্তিধন | তাঁরা লক্ষ্মী-নারায়ণের উপাসনা করেন মুক্তি লাভের আশায় | লক্ষ্মী জীবন যাপনের উপায় রূপিণী---"জীবনোপায়রূপিণী" | জীবন জীবিকার উৎস | ইনি স্বর্গে স্বর্গলক্ষ্মী | রাজগৃহে রাজলক্ষ্মী | যাঁদের জীবন পবিত্র তাঁদের সংসারে গৃহলক্ষ্মী |
লক্ষ্মীর প্রণাম মন্ত্রে সম্বোধনে তাঁকে বলা হয়েছে "শুভে" | তাঁর একটি নাম "শুভা" | অর্থাৎ শুভ-স্বরূপা , মঙ্গল-স্বরূপা মঙ্গলা বা কল্যাণ-স্বরূপিণী কল্যাণী | শুভপ্রদা , মঙ্গলদাত্রী , কল্যাণদায়িনী | যেখানে শুভ-ভাবনা , শুভ-বিচার , শুভ-সঙ্কল্প এবং শুভ-কর্ম সেখানে অবস্থান করে তিনি তাঁর "শুভা" নাম সার্থক করেন |
লক্ষ্মী নদীরূপা | লক্ষ্মী শাপভ্রষ্টা হয়ে পদ্মানদীরূপে প্রবাহিতা | পদ্মানদীরূপে প্রবহমানা হয়ে পূর্ববঙ্গের ভূমিকে করেছেন পবিত্র ও শস্য-শ্যামলা | পরম বাৎসল্যে বঙ্গ-সন্তানগণের জীবনে বরদাত্রী হয়ে ব্যাপ্তা হতেই তাঁর স্বেচ্ছায় শাপ-বরণ | তাই তো বাংলার ঘরে ঘরে বাংলা মায়ের হুলুধ্বনিতে , আলপনায় আর শঙ্খধ্বনিতে প্রতি বৃহস্পতিবার তাঁরই সমর্চন | বাঙ্গালীর মুখে মুখে বৃহস্পতিবারের লক্ষ্মীবারে রূপান্তরণ |
লক্ষ্মীর বাহন পেঁচা | লক্ষণীয় বিষয় , লক্ষ্মী যেমন পরমা সুন্দরী , তাঁর বাহনটি কিন্তু মোটেই তা নয় , অপিতু কদাকার | তাৎপর্য্য , বাহ্যিক সৌন্দর্য্য প্রতিষ্ঠার পরাকাষ্ঠা কখনই নয় | অন্তরের সৌন্দর্য্য থাকা চাই | অন্তরের সৌন্দর্য্য হল বিনয় , বিনম্রতা , নমনীয়তা | পেঁচা কদাকার হয়েও তার বিনয়পূর্ণ আনুগত্যের গুণে সর্বসৌভাগ্যের অধিষ্ঠাতৃকে ধারণ এবং বহন করে বেড়াচ্ছে | বহন করে বলেই তো সে বাহন |
পেঁচা দিবান্ধ | এখানে ভাববার বিষয় হচ্ছে , ধনশালী হলেই লোক প্রায়শ: অন্ধ হয়ে যায় | ধনী হবার আগে ভাবে-----ধন হলে সকলের উপকার করব | দীন-দরিদ্র-দুখী-আতুরের সেবা করব | আত্মীয়-স্বজনদের আর দু:খ-কষ্ট থাকতে দেব না | কিন্তু ধন পাওয়া মাত্র সে পেচক হয়ে যায় | কিচ্ছু দেখতে পায় না | তবে , লক্ষীমান হয়েও চক্ষুষ্মান--এমন ব্যক্তি কী নেই? অবশ্যই আছে | লক্ষ্মীর বাহন পেচক তাদের প্রতি ভাল কথা বলে---"ভাই আমার মতো অন্ধ হও | তবে কখন জানো ? যখন মিথ্যার পথে ধন আসবে , চুরির পথে ধন আসবে , ঘুষের পথে ধন আসবে | যারা এই সব কুৎসিৎ পথে ধনশালী হবে তাদের দিকে তাকিও না |" পেচক আবার বলে---"আমি যমের দূত | কুপথে যদি ধন অন্বেষণ কর , তবে যমের দন্ড মাথায় পড়বে | আমার প্রভু যমের চিন্তা কর | মৃত্যুর কথা ভাব | কিছুই সঙ্গে যাবে না | সুতরাং হীন পথে ধন এনো না , পবিত্র পথে ধন আয় কর | আর পবিত্র কাজে ব্যয় কর |" পেচকের উচ্চরব যেন একথাই ঘোষণা করে |
আগেই বলা হয়েছে , পেঁচা দিবান্ধ | রাত্রিতে যখন সকলে ঘুমায় পেঁচা তখন জাগে | গীতায় আছে---
"যা নিশা সর্বভূতানাং তস্যাং জাগর্ত্তি সংযমী|
যস্যাং জাগ্রতি ভূতানি সা নিশা পশ্যতো মুনে:||"
(গীতা,২/৬৯) |
ভোগীর পক্ষে যা রাত্রি , যোগীর পক্ষে তা দিন | আর ভোগীর যা দিন , যোগীর তা রাত্রি | ভোগী অধ্যাত্ম-বিষয়ে ঘুমন্ত , বিষয়সম্ভোগে সজাগ | কিন্তু সংযতেন্দ্রিয় যোগী আত্মিক বিষয়ে সজাগ , বিষয়ভোগে উদাসীন , অচেতনতুল্য |
পেচক যেন মুক্তিকামী সাধককে বলে , "সকলে যখন ঘুমোয় তুমি তখন আমার মতো জেগে থেকো | আর সকলে যখন জাগ্রত , তখন তুমি আমার মতো ঘুমোতে শেখো | তবেই সাধনে সিদ্ধি | কৈবল্যধন প্রাপ্তি |" লোকচক্ষুর অন্তরালে , নির্জনে থাকে পেঁচা | এটিও সাধকের অনুসরণীয় পন্থা | মা লক্ষ্মীর বাহনের আসনে বসে পেচক নিখিল-বিশ্ব-মানবকে এই শিক্ষাই দিচ্ছে |
(৫)
গণেশ :- দুর্গা প্রতিমার কাঠামোতে মা দুর্গার দক্ষিণে লক্ষ্মী এবং তাঁর দক্ষিণে গণেশের অবস্থান | পূজা পদ্ধতিতে আছে , "দক্ষিণে-গণপতয়ে নম:" | পূজকের দক্ষিণে গণেশুদ্দেশ্যে নমস্কার জ্ঞাপন | প্রতিমাতেও একেবারে দক্ষিণে তিনি বিরাজিত | সুযোগ্য , অধিকারী , সম্মাননীয় জনকে দক্ষিণে বসানোই আর্য্য পরম্পরা | তিনি সবার কাছে সম্মানের , এমনকি দেব সমাজেও | তাই সবার পূজ্য এবং সবার আগে পূজ্য |
গণেশ শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী | শ্রীবিষ্ণুর অংশ | পুত্র লাভার্থে শিবের আদেশে পার্ব্বতী বিষ্ণুর আরাধনা করেছিলেন | বিষ্ণুরও ছিল জগজ্জননীর বাৎসল্য-রস-সিক্ত হবার পিপাসা | তাই এলেন পুত্র গণেশ রূপে | একথা 'ব্রহ্মবৈবর্ত্ত-পুরাণ'-এ আছে | শনির দৃষ্টিতে গণেশের শির স্কন্ধচ্যুত হয় | তখন ঐরাবতের শির এনে গণেশের স্কন্ধে বসানো হল | ঐরাবতও বিষ্ণুর অংশ---"ঐরাবতং গজেন্দ্রানাং"(গীতা) |
"গজেন্দ্র-বদনং" | গণেশের মাথাটি হাতীর | হাতী সব থেকে বলশালী পশু | জগদ্ধিতায় শ্রীবিষ্ণুর পশু অঙ্গ অঙ্গীকার | এতেই তাঁর করুণা ও জীব-বাৎসল্যের বিস্তার | গণেশ রূপে এলেন হস্তীর মুখাবয়ব গ্রহণ করে এবং নৃসিংহ রূপে এলেন সিংহের বদন বরণ করে | হাতীর মতো প্রচুর বল কেন্দ্রীভূত হয়েছে গণেশের মাথায় | মাথার বল বুদ্ধি | মস্তকটিও তুলনামূলক বড় আকারের | অর্থাৎ গণেশ প্রভূত বুদ্ধির অধিকারী---"বিদ্যা-বারিধি , বুদ্ধি-বিধাতা"(তুলসী দাস) | সেই বুদ্ধি জগৎ-কল্যাণকর কার্য্যে নিয়োজিত | বেদব্যাস-মুখবিগলিত শ্রীমদ্ভাগবতাদি পুরাণ সমূহের শ্লোকমালা নিজবুদ্ধিবৃত্তি ও সিদ্ধ-হৃদয় দিয়ে উপলব্ধি করে তবে লিপিবদ্ধ করেন পুঁথির পাতায় | যার দ্বারেতে জগন্মঙ্গল হয়ে চলেছে এখনও | "ব্যাসায় বিষ্ণুরূপায়" | ব্যাস-বিষ্ণু বলছেন আর গণেশ-বিষ্ণু লিখছেন | যা লিখছেন তাও বিষ্ণু , ভগবানের বাঙ্ময়ী মূর্ত্তি--ভাগবতাদি শাস্ত্র | হস্তীর স্থির গতি | গণেশও স্থির-মতি | এজন্যেই সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ লিপিকার তিনি | মনস্তত্ত্ব বলে , যার হস্তাক্ষর যত বেশী স্পষ্ট এবং সুন্দর , তার মতি ততখানি স্বচ্ছ ও প্রশান্ত | গণেশের হস্তাক্ষর মুক্তাক্ষর | একেকটি অক্ষর উজ্জ্বল মুক্তার মতো এবং সেই অক্ষর যে পাঠ করে সেও মুক্ত হয়--তাই মুক্তাক্ষর | চোখ ছোট | মানে সূক্ষ্ম-দ্রষ্টা | বলেই সৃষ্ট সংসারের গোলকধাঁধাঁয় না ঘুরে বেড়িয়ে স্রষ্টাকেই সৃষ্টিময় দেখে | পিতা-মাতা শিব-শক্তিকে পরিক্রমা করে বিশ্বসংসার পরিব্রাজনের তৃপ্তি পায় | এর দ্বারা সময়ের সদ্ব্যহার ও পিতা-মাতার প্রতি ভগবত্তুল্য শ্রদ্ধা নিবেদনের আবেদন প্রতিপাদিত হয় | যা সর্বকালে সর্বযুগে সর্বপ্রকার উন্নতির প্রথম এবং প্রাসঙ্গিক সোপান | গণেশের নাক হাতীর শুঁড় |হাতী শুঁড় দিয়েই আহার্য্য দ্রব্যাদি মুখবিবরে প্রবেশ করায় |গণেশও তাঁর দীর্ঘ নাসার দ্বারা জীবের অতীত-সংস্কার এবং বর্তমান-কর্মের গন্ধ মস্তিস্কে প্রবেশ করিয়ে বিচার করেন , যে কার্য্যের কী পরিমাণ সিদ্ধি দেওয়া উচিৎ | হাতী শুঁড় দিয়ে আস্ত বেল মুখে নেয় এবং সার গ্রহণ করে অখন্ড অবস্থায় তা বার করে দেয় | গণেশও সারগ্রাহী |
"গণানাং ঈশ গণেশ" | গণের ঈশ্বর গণেশ | জনগণেশ | জনগণের ঈশ্বর | গণের পতি--গণপতি | জনপ্রতিনিধি , জননেতা | নিখিল জনগণের সবার সুখ-দু:খের কথা শোনেন , তাই কান দুটো বড় বড় | এটাই নেতার প্রকৃত কর্ত্তব্য | যা বর্তমানে অধিকাংশ নেতার শিক্ষণীয় বিষয় | গণপতি গণশক্তির প্রতিনিধি | গণশক্তি প্রীত থাকলেই কার্য্য সিদ্ধি | পক্ষান্তরে গণশক্তি ক্ষুব্ধ হলে মহতী বিনষ্টি | যে কর্মে গণশক্তি প্রীত , তাই সার্থক মঙ্গলানুষ্ঠান | এই জন্যেই গণদেবতার পূজা সর্ব্বাগ্রে | গণশক্তি যেখানে ঐক্যবদ্ধ , সেখানে কর্মের সব বাধা-বিঘ্ন অপসারিত হয় | এই জন্য গণেশের আর এক নাম "বিঘ্নেশ" | বিঘ্নেশকে প্রসন্ন না করে কোন কাজে হাত দেওয়া অযৌক্তিক | আর বিঘ্নেশ প্রসন্ন থাকলে নির্বিঘ্নে কার্য্যসিদ্ধি |
আজ জাতির দুর্দ্দিনে গণেশ পূজার মর্ম্ম বিশেষ ভাবে হৃদয়ঙ্গম করতে হবে | উচ্চ-নীচ , ধনী-দরিদ্র , ছোট-বড় সকল শ্রেণীর মানুষের সম্মিলন দরকার | সকলের প্রতি সকলের অকুণ্ঠ সহযোগিতা বড় প্রয়োজন | 'সবার পরশে পবিত্র করা তীর্থনীরে ' | গণেশের উদার দৃষ্টিতে ঊচ্চ-নীচ সবাই সমান | তার প্রমাণ , তাঁর মাথা হাতীর কিন্তু বাহন ক্ষুদ্র ইঁদুর | অভিজাতের সঙ্গে অবনতের মিলন ঘটানোর নামই জাতীয় সংহতি | মাথায় যাঁর হাতীর মুন্ড তাঁর বাহন ক্ষুদ্র মূষিক | কোথায় মহাকায় হস্তী আর কোথায় হীনকায় ইন্দুর | এই বড় আর ছোটর মিলন ঘটানোই জাতি গঠনের মূলমন্ত্র | ইন্দুর যত ছোটই হোক হাতীর স্বজাতি | দুইই পশু জাতি | তাছাড়া আকারগত ভাবে না হলেও , কানদুটো দুজনেরই একরকম দেখতে | পা চারখানাই | স্বজাতি যত ছোটই হোক উপেক্ষা করা উচিত নয় | এই গণেশের শিক্ষা |
এতটুকু মূষিক কি এতবড় গণেশকে বইতে পারে ? নিশ্চয়ই পারে | সমাজের দিকে তাকিয়ে দেখুন | ক্ষুদ্ররাই তো বড়কে বইছে | ক্ষুদ্রেরাই গণ বা জনতা | এরাই সমাজের প্রকৃত বল | এরা পতিত , উপেক্ষিত , ক্ষুধার্ত্ত , তবু এদের পিঠে ভর করেই সমাজের দিগ্গজেরা দাঁড়িয়ে আছে | এদের ভোটের জোরেই জননেতারা প্রতিষ্ঠিত | নেতার বাহন জনতা | গণনায়ক এই মহাসত্য প্রচার করছেন |
অথর্বশীর্ষের সায়নভাষ্যে রয়েছে , "মুষ্ণাতি অপহরতি কর্মফলানি ইতি মূষিক: |" জীবের কর্মফলসমূহ অজ্ঞাতসারে অপহরণ করে বলেই এর নাম মূষিক | গণেশ বিষ্ণু শক্তি | বিষ্ণু মুক্তিদাতা | গণেশার্চনে মুক্তি লাভ হয় | মুক্তি অর্থে অষ্টপাশের বন্ধন থেকে অব্যাহতি লাভ | কর্মফল রূপ এই পাশরজ্জু কাটতে ইন্দুরের জুড়ি নেই | দুটি দাঁতে ইন্দুর অতি শক্ত দড়ি কেটে দেয় | মোক্ষার্থীরও তো দুই দাঁত----বিবেক আর বৈরাগ্য | এই দুই দাঁতে অষ্টপাশ কর্ত্তন করতে পারলেই মুক্তি লাভ |
গণেশ বিষ্ণুশক্তি , মুক্তিদাতা পরে | আগে গণনেতা | তাই একের মুক্তিতে সুখী নন | তিনি চান সমষ্টি-মুক্তি | সকলের কল্যাণ | যে স্বার্থপর , গণেশের আশীর্ব্বাদে সে বঞ্চিত | কর্মে সিদ্ধি চাইলে গণদেবতার ভজন করতে হবে |
সিদ্ধি বলতে সর্ব্বক্ষেত্রে সিদ্ধি---
"বিদ্যার্থী লভতে বিদ্যাং ধনার্থী লভতে ধনম্ |
পুত্রার্থী লভতে পুত্রান্ মোক্ষার্থী লভতে গতিম্ ||"
--গণেশের পূজায় বিদ্যার্থী বিদ্যা , ধনার্থী ধন , পুত্রার্থী পুত্র এবং মোক্ষার্থী মোক্ষ লাভ করে |
(৬)
সরস্বতী :- সরস্বতী জ্ঞানাধিষ্ঠাত্রী দেবী | জ্ঞান-শক্তির মূর্ত্তরূপ | দেবীর চারটি হাত | চারিটি হাতে ধর্ম , অর্থ , কাম ও মোক্ষ দান করেন | ডানদিকের ওপরের হাতে স্ফটিক-মালা আর নীচের হাত বীণা বাদন রত | বামদিকের ওপরের হাতে বীণা ধরে রয়েছেন এবং নীচের হাতে পুস্তক | শুদ্ধ স্ফটিক মালায় নিরন্তর মন্ত্র জপ করে চলেছেন | স্ফটিক মালা মনকে বিজ্ঞাপিত করছে | মন হতে হবে ঐ রকম স্বচ্ছ ও নির্মল | তবে গিয়ে তা জপ করার যোগ্য হবে বা জপ করলে সার্থক হবে | কিংবা জপ করতে করতেই মলিন মন স্বচ্ছ স্ফটিকবৎ হবে | বিদ্যাশিক্ষা , সঙ্গীতশিক্ষা এবং কর্মময় জগতে আজীবিকার ক্ষেত্রে তার প্রয়োগ যেন ঈশ্বর-প্রণিধান ব্যতীত না হয় | নীচের দক্ষিণ হস্তে বীণা বাদন করে সঙ্গীত সাধনার শ্রেষ্ঠত্ব প্রতিপাদন করছেন-"গানাৎ পরতরং ন হি" | মনে রাখতে হবে সঙ্গীত কিন্তু মা সরস্বতীর দক্ষিণ হস্তের বিদ্যা | অনেকেই জ্ঞানচর্চ্চা বা শাস্ত্রচর্চ্চায় সঙ্গীতকে অবান্তর মনে করেন | "বিদ্যা ভাগবতাবধি"--অর্থাৎ বিদ্যা ভাগবত অবধি | পদ্মপুরাণের উত্তরখন্ডের ষষ্ঠ-অধ্যায়ে উল্লেখ আছে , হরিদ্বারের আনন্দতটে চতু:সন মুনি-সমাজে ভাগবত শোনাচ্ছেন | নারদ মুখ্য শ্রোতা | তাবৎ ঋষিকুল সেখানে উপস্থিত | পাঠ হচ্ছে সঙ্গীত সহযোগে ---
"প্রহ্লাদস্তালধারী তরলগতিতয়া
চোদ্ধব: কাংস্যধারী
বীণাধারী সুরর্ষি: স্বরকুশলতয়া
রাগকর্তার্জুনো~ভূৎ |
ইন্দ্রো~বাদীন্মৃদঙ্গং জয় জয় সুকরা:
কীর্ত্তনে তে কুমারা
যত্রাগ্রে ভাববক্তা সরসরচনয়া
ব্যাসপুত্রো বভূব ||"
অর্থাৎ , ভাগবতী কথার কীর্ত্তন-সঙ্গীতে প্রহ্লাদ স্ফূর্তিতে করতাল বাজাতে লাগলেন , উদ্ধব কাঁসর , দেবর্ষি নারদ বীণা , অর্জুন রাগ আলাপ ছাড়লেন , ইন্দ্র মৃদঙ্গ , সনকাদি কুমারগণ উৎসাহব্যঞ্জক জয়ধ্বনি করতে লাগলেন এবং এঁদের অগ্রভাগে ব্যাসপুত্র শুকদেব ভাবমন্ডিত-সরস বাণী-মুখে হরি-সঙ্গীতের পুষ্টি বিধান করতে লাগলেন | শ্রীমদ্ভাগবতেও রয়েছে , সরস্বতী-নদী-তটে ব্যাসের সকাশে নারদ প্রকটিত হয়ে , নিজের জীবনের কথা বলতে বলতে , তিনি যে সুর-মূর্চ্ছনায় হরিকথা পরিবেশন করে চরাচর পরিভ্রমণ করেন , সে কথা উদ্ঘোষণা করেছেন , যথা ---
"দেবদত্তামিমাং বীণাং স্বরব্রহ্মবিভূষিতাম্ |
মূর্চ্ছয়িত্বা হরিকথাং গায়মানশ্চরাম্যহম্ ||"
(ভাগবত-১/৬/৩৩)
ভারতীয় সঙ্গীত শুধুমাত্র চিত্তবিনোদনের সাধন নয় , অপিতু ভগবৎ প্রাপ্তির উপায় | ব্রহ্মস্বরূপ | নাদব্রহ্ম | যা দেবী সরস্বতী দক্ষিণ হস্তে প্রকাশ করছেন | দেবীর নীচের বামহাতে শাস্ত্র-পুঁথি | বেদ-পুস্তক | শব্দব্রহ্ম | শাস্ত্র রূপে ভগবানই ব্যক্ত | শাস্ত্রানুসারী জনকে ভগবান অনুসরণ করেন | বিদ্যা শিক্ষা সরস্বতীর থেকে প্রকাশিত , তাই একে বলে সারস্বতী-বিদ্যা | পুঁথিগত বিদ্যা অবশ্য প্রয়োজনীয় | কিন্তু তা যখন জীবনসঙ্গীতের সঙ্গে ঈশ্বরোপাসনাময় হয়ে জীবন-যাপনের সহায়ক হয় , তখনই তা পূর্ণাঙ্গ এবং সার্থক |
সরস্বতী বাণীরূপিনী | বাগ্-দেবী | বাণী হতে হবে সরস্বতীর মতো শুক্লা , শুভ্রা | তাতে অসত্যের কালিমা থাকবে না | হবে শিক্ষা-সংস্কার প্রসূতা , ঈশ্বরমুখী | তবেই তা সমষ্টিকল্যাণে নিয়োজিত হবে | সরস্বতী শুদ্ধ সত্ত্বগুণের মূর্ত্তি , তাই তিনি সর্ব্বশুক্লা | সবই শ্বেত--যিনি কুন্দফুল , ইন্দু , তুষার ও মুক্তামালার মতো শুভ্র , যিনি শ্বেতবস্ত্রপরিহিতা , শ্বেতপদ্মাসনা , শ্বেতগন্ধানুলেপনা | শ্বেত বর্ণ শান্তির প্রতীক | সরস্বতীতে ভগবন্নাম-জপ , সঙ্গীত-সাধনা এবং বিদ্যা-শিক্ষার সমন্বয় , এই কারনেই শান্তি পূর্ণত: বিরাজিতা | দেবী জগদ্বাসীকে শিক্ষা দিচ্ছেন , প্রকৃত শান্তি প্রাপ্তির উপায় এটিই | শ্বেত বর্ণটি প্রকাশাত্মক | সরস্বতী শুদ্ধ জ্ঞানময়ী প্রকাশস্বরূপা | জ্ঞানের সাধক হতে হলে সাধককে হতে হবে দেহে মনে প্রাণে শুভ্র-শুচি |
তাঁর বাহন শ্বেতহংস | জল আর দুধ মিশিয়ে দিলে হংস তা থেকে দুধটুকুই গ্রহণ করে , জল পড়ে থাকে | সুতরাং বিবেক অর্থাৎ "বিবচ্যতে ইতি বিবেক:"--বিবেচনা-শক্তি দিয়ে অনিত্য অসার অংশ বাদ দিয়ে , নিত্য সার অংশ গ্রহণ করার শিক্ষা দিচ্ছে রাজহংস | জীবের শ্বাস-প্রশ্বাসে নিরন্তর হং ও স: এই দুটি অক্ষর উচ্চারিত হচ্ছে | জীবকে এই শব্দ প্রতিনিয়ত জানাচ্ছে অহং স:--স: অহং | সেই পরব্রহ্ম আর জীব অভিন্ন | পরব্রহ্মও সচ্চিদানন্দ , জীবও সচ্চিদানন্দ | কেবল ব্রহ্ম অখন্ড , জীব খন্ড | ব্রহ্ম অসীম-অনন্ত জীব ক্ষুদ্র-সীমাবদ্ধ | ব্রহ্ম চিৎ-সমুদ্র , জীব চিৎ-কণ | হংস এই ভেদাভেদ তত্ত্বটি সর্ব্বদা স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে | 'তত্ত্বমসি'- জ্ঞান-ভান্ডার বেদান্তের মহাবাক্য , হংস মন্ত্র তত্ত্বমসি মহাবাক্যের স্মারক | তাই জ্ঞানমূর্ত্তি সরস্বতী হংসারূঢ়া |
হংস জলে থাকে কিন্তু জল তার গায়ে লাগে না | পরমহংস পুরুষও সংসারে থাকেন কিন্তু সংসার পরমহংস পুরুষে থাকে না | শ্রীভগবানও -
"আমি তো জগতে বসি , জগত আমাতে |
না আমি জগতে বসি , জগত আমাতে ||"
ভগবানের জ্ঞান-শক্তির মূর্ত্তিই সরস্বতী | সুতরাং সরস্বতী ও হংস সমধর্ম্মী | তাই বাহন |
(৭)
কার্ত্তিকেয় :- সতীর দেহত্যাগের পর শিব ছিলেন সুদীর্ঘকাল ধ্যানমগ্ন | এদিকে সতীই হিমাচল দুহিতা পার্ব্বতী বা উমা রূপে প্রকটিতা | তিনিও তপস্যারতা তাঁর চিরকালীন বর মহাদেবকে বরত্বে বরণ করবার উদ্দেশ্যে | অশুভ-শক্তি তারকাসুরের রূপ ধরে অধিকার করেছে দেবভূমি | শিব-পার্ব্বতীর পুত্রের হাতেই তার নিধন নিশ্চিত | তাই সুরগণ কামদেব ও রতিকে কৈলাসে পাঠালেন শিবধ্যান ভঙ্গ করতে | এতে শিব মদনকে ভস্মীভূত করে মদন-দহন হলেন | শিব-পার্ব্বতীর বিবাহ হল | চির দারিদ্র্য-বিভূতি বরণ করে তপস্যাময় জীবনে এগিয়ে যেতে লাগলেন জগতের আদি মাতা-পিতা | কার্ত্তিকেয়ের জন্ম হল | তিনি হর-গৌরীর তপস্যালব্ধ পুত্র | পরম সুন্দর | কামদেবকে ভস্মীভূত করে অর্থাৎ ভোগবাসনাকে ধ্বংস করে এই পুত্রপ্রাপ্তি | এটিই কার্তিকের মতো পুত্রলাভের শাস্ত্রোক্ত উপায় | ভোগবাসনা নয় , তপস্যাময় জীবনচর্য্যায় সন্তান কামনা করলে নির্মলাত্মা সন্তান ঘরে আসে | কামগন্ধহীন তপস্যার ফল চিরকালই সুন্দর | তাই কার্ত্তিকেয় চির সুন্দর |
কার্ত্তিকেয় প্রতিষ্ঠিত হয়েছিলেন দেব-সেনাপতিত্বে | দৈবী কর্ম্মে | তপস্যার ফসল যে সন্তান তার মধ্যে দৈবীভাবেরই বিকাশ স্বাভাবিক , যা দৈবী-কর্ম্মে নিয়োজিত হয়ে জগন্মঙ্গলের হেতু হয় | এই জাতীয় সন্তানই বংশের মুখ উজ্জ্বল করে | কার্ত্তিকেয় মহাপরাক্রমশালী যোদ্ধা | যুদ্ধে শৌর্য্য-বীর্য্য লাগে | কার্ত্তিকেয়তে তা পূর্ণমাত্রায় আছে | জীবনও একটা সংগ্রাম | পরিস্থিতি সাপেক্ষে এখানেও শৌর্য্য-বীর্য্যের দরকার পড়ে | তখন কার্ত্তিকেয়কেই আদর্শ রূপে গ্রহণ করতে হয় | তারকাসুরকে বধ করে স্বরাজ্য-ভ্রষ্ট দেববৃন্দকে পুনরায় হৃতরাজ্যে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন তিনি | পরাধীন দেবগণকে করেছিলেন স্বাধীন | কুমার কার্ত্তিকেয় যুবশক্তির প্রতীক | স্বাধীনতা সংগ্রামের বীর সৈনিক |
কার্ত্তিকেয়র বাহন ময়ূর | ময়ূর দ্রুত গতিতে ওড়ে | তাই তা দ্রুত গতির দ্যোতক | আলস্যহীন , নি:স্বার্থ জীবনের গতি যত দ্রুত সম্ভব দৈবীকার্য্য উৎসর্গীকৃত করাই জীবনের মহত্ত্ব | কার্ত্তিকেয় সুন্দর , ময়ূরও সুন্দর | কার্ত্তিকেয় তাঁর সৌন্দর্য্য কেবল দেখিয়ে বেড়ান না | ঐ সুন্দর দেহ লাগান ধর্ম্মযুদ্ধে , দেবরাজ্য উদ্ধার সাধনে | ময়ূর পেখমটি লাগায় সর্পের সঙ্গে যুদ্ধে | একজন আদর্শ সৈনিকের গুণ ময়ূরে লক্ষিত | এইজন্যেই কার্ত্তিক তাকে বেছে নিয়েছে | সৈনিক হিংসাকারীকে সহ্য করে না | হিংসাকারীর প্রতীক সর্প | ময়ূরও সর্পকে সহ্য করে না | মানব সমাজে যা ধ্বংসকারী বিষ ছড়ায় , সেই বিষধরকে ময়ূর গ্রাস করে | সংসারধ্বংসকারী দানবীয় ভাব কার্ত্তিকেয়ের শত্রু | পেখমরূপী ঢাল দিয়ে ময়ূর বিষধরকে ঠেকায় , ঠোঁট আর নখ দিয়ে তাকে নাশ করে | ময়ূরের যুদ্ধ-কৌশল দেখবার মতো |
বীর হবে অনলস | আলস্য , দীর্ঘসূত্রতা তার কাছে ঘেঁষতে পারে না | ব্রাহ্মমুহূর্ত্তে শয্যাত্যাগ আলস্যহীন ব্যক্তির সর্ব্বপ্রধান লক্ষণ | ময়ূর নিত্য সর্ব্বাগ্রে উঠে সকলের ঘুম ভাঙ্গায় | ময়ূর নিদ্রাজয়ী |
পশু-পাখীর সহজাত স্বভাব , খাদ্যদ্রব্য পেলে অপরকে ঠেকিয়ে , নিজে কিভাবে খাবে , সেই চেষ্টায় অস্থির | এর নাম স্বজন-দ্রোহিতা | ময়ূর , কুক্কুট প্রভৃতি প্রাণীর অন্তরে আছে তদ্বিপরীত ভাব , স্বজনপ্রীতি | যা পায় সকলে ভাগ করে খায় | যে জন এই গুণের অধিকারী , তার দ্বারাই প্রকৃতার্থে সমষ্টি-কল্যাণ হয় | জনবল সর্ব্বদা তারই সঙ্গে আর কৃতকার্য্যতা তো তার করতলগত | স্ব-স্ব সংসার-রাজ্যে সবাই নেতা বা কর্ত্তা | সংসারের প্রত্যেক কর্ত্তার ক্ষেত্রেই ময়ূরের গুণাবলী গ্রহণীয় | ময়ূরের মতো আলস্যহীনতা , কর্ম্মকুশলতা , বিষাক্তভক্ষণ , স্বজন-প্রীতি , তার উপর আবার সৌন্দর্য্য গুণাবলীর ক্রমবিকাশ কার্ত্তিকেয় এবং তাঁর প্রিয় বাহনের আদর্শে প্রাণিত হলে পরে অবশ্যম্ভাবি |
সরস্বতী জ্ঞানমূর্ত্তি , সুতরাং ব্রাহ্মণ্য-শক্তির প্রতীক | কার্ত্তিকেয় বল-বীর্য্যের দ্যোতক , তাই ক্ষাত্র-শক্তির প্রতীক | লক্ষ্মী ধনাধিষ্ঠাত্রী , কাজেই বৈশ্য-শক্তি | গণেশ গণশক্তি , অতএব শ্রমিক ও শূদ্রশক্তির প্রতীক | সবগুলোই শক্তি | কার্য্য-ক্ষমতার নাম শক্তি | কার্য্যের এই রূপ ক্ষমতায়ন সুশৃঙ্খল সমাজ রচনায় বরণীয় | এখানে ছোট-বড়'র বিভেদ ভাবনা ভিত্তিহীন এবং অযৌক্তিক | সকলেই সম-মর্য্যাদায় সমাসীন | সকলেই পূজ্য | তাই দুর্গাপুজোয় প্রত্যেকের পূজা হয় | বিশ্ব-কর্মযজ্ঞে সব শক্তিই প্রয়োজনীয় , সমাদরণীয় | সবাই পরস্পর পরস্পরের পরিপূরক , পরিপোষক | সরস্বতী দেবেন নীতি | লক্ষ্মী দেবেন সম্পত্তি ও সমৃদ্ধি | গণেশ দেবেন পরিশ্রম ও কার্য্যসিদ্ধি | কার্ত্তিকেয় দেবেন পরাক্রম | আর তার প্রাণকেন্দ্রে এই শক্তি সমূহের প্রধানা পরিচালিকা-শক্তি রূপে থাকবেন পরাশক্তি দুর্গা | একাধারে এই সমস্ত শক্তির সম্মিলিত সমর্চনই দুর্গোৎসব | মহা মিলনোৎসব | যে ভাবনায় বাঙ্গালী প্রতিদিন নতুন করে বাঁচে | বাঙ্গালী কোনদিনই জাতিভেদ মেনে নেয় নি | তা সে যত দর্শনসমৃদ্ধ ধারণাই হোক | তাই তো বাঙ্গালীর প্রাণে শ্রীচৈতন্য বিরাজ করেন | যিন রক্ষণশীলতার বুকে দাঁড়িয়ে বলেছিলেন এবং বাস্তবায়িত করেছিলেন , "চন্ডালো'পি দ্বিজশ্রেষ্ঠঃ হরিভক্তিপরায়ণঃ |" কিংবা "কৃষ্ণ ভজনে নাই জাতি-কুলাদি বিচার |" রচনা করেছিলেন এমন সমাজ যেখানে-"ব্রাহ্মণে চন্ডালে/করে কোলাকুলি/কবে বা ছিল এ রঙ্গ//" | বাঙ্গালী পাগল হয় 'জয় নিতাই' বলে | যেহেতু তিনিই হলেন এই চৈতন্য-ভাবনার বিশ্বকর্মা , রূপকার | যে কর্ম-বলয়ের যোগপীঠ এই বাংলা | বাঙ্গালী বরণ করেছে ঠাকুর রামকৃষ্ণকে | যেহেতু তিনি ভেদাভেদরহিত সমন্বয়ের মূর্ত্ত বিগ্রহ | জাতীয় উৎসব হিসেবে লালন করেছে শারদীয়া দুর্গোৎসবকে | কেননা , এ যেন সমাজের সর্ব্বস্তরীয় শক্তির মিলনঘন প্রতীমা | যা শুধুমাত্র মাটির পুতুল নয় | জীবন্ত মানব দর্শন | একটু গভীর ভাবে ভাবলে আমরা নিজেদেরকেও খুঁজে পাব ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্য্যন্ত দুর্গাপূজার এই ক্রমে | কল্পারম্ভ-- অর্থাৎ নব-জীবনারম্ভ | বোধন-- মাতৃগর্ভে ভ্রুণের মধ্যে প্রাণের সঞ্চার | সপ্তমীর সকালে নবপত্রিকার পূজালয়ে প্রবেশ--অর্থাৎ শিশুর জন্ম | মহাষ্টমীর পূজা--কৈশোর | মহাষ্টমীর শেষের এক দন্ড অর্থাৎ চব্বিশ মিনিট এবং মহানবমী প্রারম্ভের এক দন্ড অর্থাৎ চব্বিশ মিনিট , মোট এই দুই দন্ড বা আটচল্লিশ মিনিট , যাকে এক মুহূর্ত্ত কাল বলা হয় , মাত্র এই সময় কাল সন্ধিক্ষণ | এই সন্ধিক্ষণে সন্ধিপূজা-- যৌবন | যা ক্ষণস্থায়ী অথচ সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ | এরপর মহানবমী-পূজা--প্রৌঢ়ত্ব | মহানবমী পূজার শেষে কুমারী পূজা--এক ভবিষ্যৎ জন্মদাত্রীর পূজা | তারপর হোম অর্থাৎ মহাকালের মহাযজ্ঞে ধীরে ধীরে অনুপ্রবিষ্ট হওয়া | বিজয়া দশমীতে বিসর্জ্জন---জীবনের অন্তিম পর্ব | নবপত্রিকা বিসর্জ্জনে কদলী , কচু , হরিদ্রা , জয়ন্তী , বেল , দাড়িম্ব , অশোক , মান ও ধান এই নয় পত্রিকার মধ্যে আট'টি পত্রিকা মন্ত্রোচ্চারণে নদী-জলে বিসর্জ্জিত হয় , কিন্তু ধান তীরে রাখা হয় | কেননা , তা "প্রাণিনাং প্রাণবর্ধিণি" অর্থাৎ অন্ন হয়ে জীবন রক্ষণ ও বর্দ্ধন করে | জীবন নদীর তটে তাকে রেখে আবার আমরা শুরু করি শুরুর পর্ব | যা শেষ হয়েও শেষ হয় না | যার বিসর্জ্জনেও শোনা যায় আবাহনের অনুরণন---"পুনরাগমনায় চ" | যা প্রতিধ্বনিত হয় বিশ্ব-বাঙ্গালীর অন্তরে-বাহিরে----"পুনরাগমনায়ন চ" | "পুনরাগমনায় চ" | "পুনরাগমনায় চ" |
তথ্য-সূত্র :-
১. শব্দকল্পদ্রুম |
২. শ্রীশ্রীচন্ডী |
৩. দেবদেবী ও তাঁদের বাহন - স্বামী নির্মলানন্দ |
৪. শ্রীমদ্ভগবদ্গীতা |
৫. মা দুর্গার কাঠামো - ড. মহানামব্রত ব্রহ্মচারী |
৬. সাধন-সমর - ব্রহ্মর্ষি শ্রীসত্যদেব |
৭. পূজা-বিজ্ঞান - স্বামী প্রমেয়ানন্দ |
৮. শ্রীমদ্ভাগবতম্ |
৯. অথর্ব-বেদ |
১০. পদ্মপুরাণ |
১১. ত্রিপুরাণোক্ত দুর্গাপূজা পদ্ধতি |
- Get link
- X
- Other Apps
Comments
Post a Comment