রবীন্দ্র-আলোকে ললিত ভারতী—সমীপেষু দাস

  রবীন্দ্র-আলোকে ললিত ভারতী


কাব্যসরস্বতী কোনো মন্দিরের বন্দিনী দেবতা নন

                                                                                                      ( মধুমঞ্জরি, বনবাণী ) 

                      রবীন্দ্রনাথ কাব্য ও সংগীতকে কখনওই পৃথক ব’লে ভাবতেন না। প্রথম জীবনের তাঁর কাব্যগুলির নামকরণ-ই তার যথাযথ প্রমাণ – সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল  ইত্যাদি। এমনকি যে কাব্যের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান; তা-ও গীতাঞ্জলি। তাঁর রচিত অসংখ্য কবিতা-ই গানের রূপ পেয়েছে। ব্যক্তিজীবনে তিনি তাঁর কাব্যরচনার প্রেয়সীরূপে পেয়েছিলেন তাঁর ‘নতুন বৌঠান’ তথা কাদম্বরী দেবী-কে। তিনি যখন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে আসেন; তখন বয়সে তিনি বালিকা। তাই সেই ছবিই পরবর্তীতে রবীন্দ্রনাথের নাটকে ধরা দিয়েছে। বাল্মীকি-প্রতিভা ও বিসর্জন এই দুই নাটকেই দেখা যায় নাটকের নায়কের আন্তরিক উন্নতি ঘটেছে একজন বালিকার হৃদয়স্পর্শে। বাল্মীকি-প্রতিভা  গীতিনাট্যের শেষ দৃশ্যে দেখি দেবী সরস্বতী বাল্মীকি-কে কবিত্ব-দান করেছেন। বনদেবীদের গানে উষাময়ী বাণীবিনোদিনী দেবীর স্তুতি ক’রে সম্বোধন করেছেন ‘ভারতী’ ধ্বনিতে –

                                              নমি নমি ভারতী তব কমলচরণে


সংস্কৃত সাহিত্যের নন্দনতত্ত্বের গ্রন্থের মঙ্গলাচরণে সাধারণতঃ শিব, কৃষ্ণ ও সরস্বতীর স্তুতি হয়ে থাকে। কাব্যাদর্শ, সরস্বতীকণ্ঠাভরণ  প্রভৃতি গ্রন্থে আমরা সরস্বতীর প্রতি নিবেদন লক্ষ্য করি। ভোজদেব সরস্বতীকণ্ঠাভরণ-এর মঙ্গলাচরণেই বলেছেন ধ্বনি,বর্ণ,পদ,বাক্য এই চতুষ্টয়ই যেন দেবীর বরাভয় মুদ্রায় শোভিত। ভারতীয় সংস্কৃতিতে এই দেবী ললিতকলার পূর্ণ প্রতিমা। বিদ্যা, কলা, শিল্প যে কোনওকিছু শিক্ষার প্রারম্ভিক পর্বে সরস্বতীর আরাধনা হয়ে থাকে। তাই একাধারে এই দেবীর মূর্তিকল্পনায় শৃঙ্গার রসের আবহ বীণা যেমন রয়েছে; তেমনই ভক্ত-রসিকের চিত্তে ভক্তিরস অবিভক্ত। রবীন্দ্রনাথ বনবাণী কাব্যগ্রন্থের মধুমঞ্জরি কবিতায় বলেছেন –

                                        কাব্যসরস্বতী কোনো মন্দিরের দেবতা নন

পারিবারিক সূত্রে ব্রাহ্মধর্মের সঙ্গে যুক্ত থাকায় সেই প্রাতিষ্ঠানিকতা তার মনে মায়ার সঞ্চার করলেও আত্মায় মাধুরী বিস্তৃত করতে পারেনি। যে কোনও দেবতাকেই তিনি প্রেম, সৌন্দর্য ও নান্দনিকতার সঙ্গে পূজা করেছেন। বৈষ্ণব কবির গান প্রবন্ধগ্রন্থেও ভারতীয় সংস্কৃতির আচরিত ভক্তিভাবকে উপেক্ষা না করেও প্রেম ও সুন্দরের অপেক্ষায় তাকে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তাঁর গান “মধুর মধুর ধ্বনি বাজে”-র মধ্যেও কোথাও ‘সরস্বতী’ শব্দের ব্যবহার নেই ; কিন্তু সেই ভাব-ই এখানে প্রকাশিত। দণ্ডী কাব্যাদর্শ গ্রন্থে বলেছিলেন যে কারোর চিরন্তনী প্রতিভা না থাকলেও সরস্বতীর কল্যাণে সে কাব্যরচনা করতেই পারে-

বাল্মীকি-প্রতিভা গীতিনাট্যেও সেই একই কথার ছন্দোময় রূপ। এখন এই সরস্বতীর বহু নামের মধ্যে একটি নাম ‘ভারতী’। জোড়াসাঁকো-ঠাকুরবাড়িতে এই নামে একটি পত্রিকা-ও নিয়মিত প্রকাশিত হ’ত।এখন এই নামটির তাৎপর্য যদি আমরা যুক্তিযুক্ত পদ্ধতিতে ব্যাখ্যা করতে পারি; তবেই আত্মস্থ করতে পারব দেবীর ললিত রূপের অনুধ্যানের হেতু। 

       ভারতীয় সংস্কৃতির ইতিহাসের অনুসন্ধান করলেই আমরা দেখতে পাব ঋগ্বৈদিক সাহিত্যে সরস্বতী ছিল ‘অম্বিতমা’ বা ‘নদীতমা’(৭|৯৫)। মূলতঃ তৎকালীন সেচকার্যের জন্য সরস্বতীর মান্যতা ছিলই। সেই কারণেই তার উদ্দেশ্যে স্তুতি করা হত,যেগুলি বলতে গেলে এখনকার দৃষ্টিতে স্তোত্রসঙ্গীত। কৃষিকাজ ও পশুপালন বৃত্তি-ও সেই সময়ে ‘বিদ্যা’(বার্তা)রূপে গণ্য হত। সুতরাং বিদ্যার সঙ্গে দেবী সরস্বতীর ও গীতির যোগসূত্র রয়ে গেল। অন্যদিকে ভারতীয় জ্যোতিষশাস্ত্র অনুযায়ী বুধগ্রহের বিশেষণে বলা হয়েছে ‘বাণী’(গ্রহভেদাধ্যায়,লঘুজাতক)। বুধ কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত দুই রাশি মিথুন ও কন্যা রাশির বিবৃতিতেও দেবী সরস্বতীর সৌরভ পেয়ে থাকি। কারণ মিথুন রাশির চিত্রকল্পতে নারীর হাতে থাকে বীণা এবং কন্যা রাশিতে দেখি নদীর মধ্যে নৌকাস্থ এক কন্যার হাতে শষ্য ও প্রদীপ (হোরাতন্ত্র)। একথা বুঝতে অসুবিধা হয় না যে এটি জ্ঞানের আলো ও কৃষিকাজকেই বোঝাচ্ছে। আবার বুধের থেকেই আসে মানুষের সুবুদ্ধি, মেধা ও জ্ঞানশক্তি। এমনকী বুধগ্রহের বর্ণ-ও ‘শুকতনুবর্ণ’ অর্থাৎ টিয়াপাখির মত সবুজ । একটা বিষয় লক্ষ্য করার মত যে টিয়াপাখি মানুষের গলার স্বরের অনুকরণ করতে পারে। খুবই স্পষ্ট যে বাক্, বুদ্ধি, শিল্পের এক সারিতে মেলবন্ধন। উত্তরকালামৃত  নামক ফলিত জ্যোতিষশাস্ত্র গ্রন্থের মতানুসারে বুধগ্রহের থেকে বাকপটুতা, শিল্পকর্ম, সাহিত্য এসে থাকে। আমরা সরস্বতী পুজোর দিন সবাই দেবীর কাছে প্রার্থনা করি যাতে আমরা বিদ্যা এবং বুদ্ধিলাভ করতে পারি। 

           কিন্তু এই দেবীকে কেন 'ভারতী' বলা হয় তার মীমাংসা করতে গেলে আমাদের চারুকলাশাস্ত্রের দিকে তাকাতেই হবে। আমরা জানি যে এখনও পর্যন্ত ভারতীয় কলাতত্ত্বের প্রথম গ্রন্থ ভরত-কথিত নাট্যশাস্ত্র। কিন্তু এই গ্রন্থ কখনওই ভরত নামক কোনও ঋষিপ্রণীত নয়। কোষগ্রন্থ অনুযায়ী ‘ভরত’ শব্দের অর্থ ‘নট’ বা অভিনেতা (অমরকোষ,২।১০।১২) অর্থাৎ বৃহদর্থে বাচিক শিল্পী; তাদের মধ্যে অভিনেতা, আবৃত্তিকারী, হরবোলা, গল্পকথক, সংগীতশিল্পী, অনুষ্ঠানসঞ্চালক, নর্তক সকলেই রয়েছে। সেই কারণেই সংলাপপ্রধান নাটকের বিশিষ্টতাকে ‘ভারতী বৃত্তি’ বলা হয়। সুকুমার সেনের ভারতীয় আর্য সাহিত্যের ইতিহাস-এ পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে বলতে পারি বহুপূর্বে কথক সম্প্রদায়ের মানুষেরাই যাদের বলে ‘বাগজীবন’, তারাই কৌরব-পাণ্ডবদের কথাকে লোকচিত্তরঞ্জনের জন্য পরিবেশন করত, তাই সেই ভরত-দের দ্বারা কথিত আখ্যানই একদিন ভারত-সংহিতা ও তারও পরে গুপ্তবংশের সময়ে মহাভারত নাম পেয়েছিল। সেই থেকেই নটদের প্রধান আরাধ্যদেবী হয়ে পড়ে  এই সরস্বতী বা বাগ্দেবী (দেবাধিদেবকাণ্ড,অভিধানচিন্তামণি); কোনও ভরত বংশীয় রাজা ও তদবংশের কীর্তিগাথার জন্য নয়। যদিও মণিরত্ন মুখোপাধ্যায় লুপ্ত সরস্বতী গ্রন্থে বলেছেন যে ভরত বংশের রক্ষাকর্ত্রী বলে দেবী ‘ভারতী’ অভিধায় পরিচিত হতে থাকে। তবে এই যুক্তির চেয়ে বাগাশ্রয়ী কলার সঙ্গে নামটিকে যুক্ত করাই বেশি সঙ্গত বলেই মনে হয়। 

      সুতরাং উপরিউক্ত আলোচনা থেকে স্পষ্ট হয়ে উঠছে  performing arts-এর অনুষঙ্গে এই দেবী শিল্পীদের সঙ্গলাভ করেছেন সহজাতভাবেই। রবীন্দ্রনাথ একজন মানুষ; তাই তিনি মানুষের সকল অনুভবকে লেখনিতে স্থান দিয়েছেন। শুধু অস্ত্র বা উপচারের মাধ্যমে রূপককল্পে নয়; একটি রূপে দেবীর নিত্য উপাসনা করতে চেয়েছেন। জীবনস্মৃতি থেকে জানা যায় বাল্মীকি-প্রতিভার পূর্ব সময় পর্যন্ত তিনি কালিদাসের কুমারসম্ভব মহাকাব্যের একটি পাঠ নিয়েছিলেন কিন্তু সমগ্র সংস্কৃত সাহিত্যের সাহচর্য তখনও পাননি। প্রাচীন যুগে ভারতীয় শিল্পসৌন্দর্যের বিশ্লেষণাত্মক সব শাস্ত্রগ্রন্থের ভাষা অনুষ্টুপ ছন্দে লেখা সংস্কৃত ভাষা। বাল্মীকির রামায়ণের প্রথম কাণ্ডে বাল্মীকির উক্তিতেই “মা নিষাদ….” ইত্যাদি শ্লোক নির্গত হয়। রবীন্দ্রনাথের এই গীতিনাট্যে সেই ঘটনার অনুকরণ বা অনুসরণ নেই; বরং বিহারীলাল চক্রবর্তীর সারদামঙ্গল কাব্যের প্রভাব বিস্তর। তাই এই গীতিনাট্যকে কখনওই রামায়ণ-আশ্রিত বলা যাবেনা। যেহেতু তিনি গীতিনাট্য ধারার নাট্যনির্মাণ করেছিলেন সেই সময়ে, তাই কাব্য ও গীতির একটি সমাবেশ যেন রাখতেই চাইছিলেন এবং সেই কারণেই সরস্বতী সেখানে অজ্ঞানতা, অসারতা, মোহময়তার বিপরীতে অবস্থান করছেন। শান্তিনিকেতনে বাস করার সময়েও ঋতুনাট্যে তিনি কাব্যের সঙ্গে সংগীতের সন্ধি করানোর প্রসঙ্গে একটি ললিত নারীমূর্তির কল্পনা দিয়েছেন। শ্রাবণগাথা, শেষ বর্ষণ  যার দৃষ্টান্ত। ব্রাহ্মধর্মে থেকে পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুরের সৌজন্যেই তিনি সত্য, শিব ও সুন্দরের ধারণা পেয়েছিলেন। তাই প্রকৃতি পর্যায়ের গানে অবিরাম প্রকৃতির প্রতি স্তুতি বা বন্দনা। তাই ভারতীয় কৃষ্টি ও সংস্কৃতির চর্চিত এই দেবীর উজ্জ্বলতাকে তিনি যেন আবারও প্রতিষ্ঠা দিলেন কর্ম ও মর্মের অমৃত ধর্মবাণীতে।


—সমীপেষু দাস। 

Comments

Popular posts from this blog

মাতৃরূপেণ—১২, 'অন্নপূর্ণে সদাপূর্ণে....'—শ্রীজীবশরণ দাস

কালীকথা-৩—পরমব্রহ্ম শবরূপ তাই — ড. অর্ঘ্য দীপ্ত কর

মাতৃরূপেণ—৫, বঙ্গ-মননে পরিবার-সমন্বিতা দুর্গা দর্শন—রাধাবিনোদ ঠাকুর