রবীন্দ্র-আলোকে ললিত ভারতী—সমীপেষু দাস

Image
  রবীন্দ্র-আলোকে ললিত ভারতী কাব্যসরস্বতী কোনো মন্দিরের বন্দিনী দেবতা নন                                                                                                       ( মধুমঞ্জরি, বনবাণী )                        রবীন্দ্রনাথ কাব্য ও সংগীতকে কখনওই পৃথক ব’লে ভাবতেন না। প্রথম জীবনের তাঁর কাব্যগুলির নামকরণ-ই তার যথাযথ প্রমাণ – সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল  ইত্যাদি। এমনকি যে কাব্যের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান; তা-ও গীতাঞ্জলি। তাঁর রচিত অসংখ্য কবিতা-ই গানের রূপ পেয়েছে। ব্যক্তিজীবনে তিনি তাঁর কাব্যরচনার প্রেয়সীরূপে পেয়েছিলেন তাঁর ‘নতুন বৌঠান’ তথা কাদম্বরী দেবী-কে। তিনি যখন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে আসেন; তখন বয়সে তিনি বালিকা। তাই সেই ছবিই পরবর্তীত...

মাতৃরূপেণ—৬, দেবী দুর্গার দশ হাত ও সপরিবারে পুজোর নেপথ্যে—সত্যজিৎ বাগ

 দেবী দুর্গার দশ হাত ও সপরিবারে পুজোর নেপথ্যে

বঙ্গে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে দেবী দুর্গার যে রূপের পুজো হয়, সেই রূপের পুজো ভারতের বাকি প্রদেশগুলিতে অবাঙালীদের মধ্যে তেমন দেখতে পাওয়া যায় না। অন্যদিকে আরেকটি বিষয়ও লক্ষ্য করার- যেটি হলো বাংলায় দেবী দুর্গার এত জনপ্রিয়তা থাকলেও সেই অর্থে দেবীর মহিষাসুরমর্দিনী রূপে মন্দিরে পুজো পাওয়ার ঘটনা একেবারেই নগণ্য, বরং সেই স্থান শীতলা, কালী, মনসা, চণ্ডী এঁদের দখলে। বাকি ভারতে দেবী দুর্গার যে রূপগুলির সচরাচর পুজো হয় তার মধ্যে উত্তর ভারতে অষ্টভুজা শেরাওয়ালি, বৈষ্ণবী, অম্বিকা ও দক্ষিণ ভারতে কাঞ্চী- কামাক্ষী, ললিতা, মারি-আম্মা, ভুবনেশ্বরী প্রভৃতি রূপেরই প্রচলন বেশী এবং রূপগুলির সকলেই চার হাতের হয়ে থাকেন। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য যে দক্ষিণ ভারতের দেবী দুর্গার রঙের স্বকীয়তা রয়েছে। এখানে দেবীর রঙ প্রধানত সবুজ এবং দেবীর বাস নিম গাছে। দেবীর উপচারে নিমপাতা ও পাতি-লেবু বিশেষ গুরুত্ব পায়। দেবী আবার এখানে বসন্ত নিরাময়কারী রূপে বিরাজমান, যেটি আমাদের বাংলায় শীতলার অধিকারে। দেবীর কাছে সর্প বিরাজমান থাকে, বাংলায় যেটি মনসার অধিকারেই পাওয়া যায়। ব্যতিক্রম হিসেবে দক্ষিণ ভারতে দেবীর দুর্গা-কালী রূপে এক পুজো হয়, যেটি উগ্র স্বরূপা, দশ হাত ও ঠোঁটের দু দিকে দাঁত বেরিয়ে আছে, দেবীর কুটিল ভ্রুকুটি চাহনি। বলাই বাহুল্য যে, দেবীর এই রূপ মহিষাসুরমর্দিনী রূপের সমগোত্রীয় হলেও বাংলায় এই রূপ অচল। আবার ভারতের সর্বত্র মহিষাসুরমর্দিনী রূপের পুজো বাড়ীতে না করার পরামর্শই দিয়ে থাকেন শাস্ত্রীয় পণ্ডিতেরা। কারণ, গৃহস্থের দেবীর শান্ত ও কল্যাণকারী রূপের পুজো করাই কর্তব্য। যেহেতু মহিষাসুরমর্দিনী রূপের সাথে উগ্রতা ও মহিষাসুর, রক্ত, হিংস্রতা জড়িয়ে আছে তাই এই রূপের পুজো ভারতে অবাঙালী সমাজে দেখা যায় না। অন্যদিকে বাংলায় দেবীর এই রূপেরই জয়জয়কার এবং দেবী এখানে শান্তস্বরূপিণী। সঙ্গে লক্ষ্মী, সরস্বতী, কার্তিক, গণেশ সহ উর্দ্ধে মহাদেব বিরাজমান। তাহলে এই মূর্তির আগমন কিভাবে?


আমরা যে দুর্গাকে আরাধনা করি, নিজেদের ঘরের মেয়ে মনে করি তিনি কিন্তু দেবী সতী নন। তিনি পার্বতী বা পর্বত (হিমালয়) দুহিতা। দক্ষযজ্ঞের  সময়ে শিবহীন যজ্ঞ ও শিবের প্রতি করা কটূক্তি সইতে না পেরে দেবী সতী আত্মহত্যা করেছিলেন। ইনিই পরের জন্মে হিমালয়ের কন্যা হয়ে জন্মে শিবকে পতিরূপে কামনা করে তপস্যা করেন ও শিবকে লাভ করেন। দেবীর গাত্রমল থেকে গণেশ ও শিবের ঔরসে কার্তিকের জন্ম হলেও লক্ষ্মী ও সরস্বতী যে দুর্গা ও শিবের কন্যা এমন কোন প্রমাণ শাস্ত্রে দেখা যায় না। বরং চণ্ডী তে দেবী মহালক্ষ্মী ও দেবী মহাসরস্বতী দেবী দুর্গারই রূপ হিসেবে প্রতিভাত হয়েছেন। সেই অর্থে দেখলে দেবীর কন্যা স্বরূপিণী হিসেবে বাঙালী হয়ত এভাবেই এই দুই দেবীকে মেনে নিয়েছে, আপন করেছে। দক্ষযজ্ঞের আগুনে সতী প্রাণ দিয়েছিলেন বলে দেবী পার্বতীর গাত্রবর্ণ হয় কালো। এই কালো রঙ নিয়ে শিব দেবীকে অন্যান্য দেবীদের সম্মুখে অবজ্ঞা করলে দেবী ঘোরতর তপস্যা করে দেহের কৃষ্ণকোষ ত্যাগ করে গৌরবর্ণের অধিকারিণী হলেন ও নাম পেলেন গৌরী। অন্যদিকে ওই কৃষ্ণকোষ থেকে জন্মালেন আরেক দেবী কৌশিকী। এই দেবী কৌশিকীই দেবী কালিকা বা ভদ্রকালিকা। যাঁর দশ হাত, যাবতীয় লোভ, ক্রোধ, পাপ, কাম ধ্বংস করাই যাঁর প্রধান কাজ। মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারে, মহিষাসুরমর্দিনী চণ্ডী ও ভদ্রকালী অভিন্না। মহাভারতে ভদ্রকালী দুর্গার অপর নাম। কালিকাপুরাণ ও দেবীপুরাণ অনুসারেও, ভদ্রকালী দুর্গারই রূপান্তর। আবার সরস্বতীকেও ভদ্রকালী নামে অভিহিত করা হয়ে থাকে। মূর্তি কল্পনায় ড. হংসনারায়ণ ভট্টাচার্যের মতে,- “ ভদ্রকালী নামে শক্তিদেবতার যে রূপ কল্পিত হয়েছে, তার মধ্যেও তিন প্রকার ভেদ সুস্পষ্ট। ভদ্রকালী কখনও মহিষাসুরমর্দিনী দুর্গা, কখনও দক্ষযজ্ঞবিনাশিনী ও ভয়ংকরী চামুণ্ডারূপিণী।” কালিকাপুরাণ অনুযায়ী, ভদ্রকালীর মূর্তি উক্ত পুরাণে বর্ণিত দুর্গামূর্তির অনুরূপ। এই মূর্তি ষোড়শভূজা, নীল অতসীপুষ্পবর্ণা, মস্তকে জটাজুট ও চন্দ্রকলা শোভিতা, কণ্ঠদেশে নাগহার ও স্বর্ণহার পরিহিতা, দক্ষিণ হস্তসমূহে শূল, চক্র, খড়্গ, শঙ্খ, বাণ, শক্তি, বজ্র, দণ্ড এবং বাম হস্তসমূহে খেটক, ঢাল, ধনু, পাশ, অঙ্কুশ, ঘণ্টা, পরশু ও মুষল ধারিণী। সিংহপৃষ্ঠে দণ্ডায়মান অবস্থায় বামপদে মহিষাসুরকে আক্রমণ করে তিনি তাঁকে শূলের দ্বারা বিদ্ধ করেছেন। চণ্ডীর বর্ণনায় "চিক্ষেপ চ ততস্তত্তু ভদ্রকাল্যাং মহাসুরঃ। জাজ্বল্যমানং তেজোভি রবিবিম্বমিবাম্বরৎ।। (৩য় অধ্যায়, নবম শ্লোক)। ইনি অযোনিজাতা এবং এনার হাতেই যে মহিষাসুরের মৃত্যু হবে তা মহিষাসুর স্বপ্নের মাধ্যমেই জানতে পেরেছিলেন। এ কারণে মহিষাসুর দেবীর পুজো করে তুষ্ট করে বর চান। দেবী বধ করবেন না- এই বর না দিয়ে অন্য বর দিতে চাইলে মহিষাসুর দেবতাদের যজ্ঞভাগ চেয়ে বসেন। দেবী তা অসম্ভব জানিয়ে নিজের পুজোর অংশ দেবেন বলে বর দেন (কালিকাপুরাণ)। সেই থেকে মহিষাসুরমর্দিনী রূপে দেবী দুর্গার মূর্তিতে মহিষাসুর অবস্থান করে আসছেন। অন্যদিকে চণ্ডীর ব্যাখ্যায় দেবীর অম্বিকা রূপের পাশাপাশি মহিষাসুরের সৈন্য বধ ও মহিষাসুরের বধের সময় দেবী ভদ্রকালী রূপ ধারণ করেছিলেন। মার্কণ্ডেয় পুরাণ অনুসারেও দেবী দুর্গা ভদ্রকালী রূপেই মহিষাসুরের বধ করেছিলেন। একারণেই দেবী দুর্গা কাত্যায়নী রূপে আঠারো হাতের হলেও মহিষাসুর বধের সময় তিনি দশভুজা।

অন্যদিকে বাঙালীর সপরিবার দেবী মূর্তির প্রথম রূপ দেন ১৬১০ সালে বড়িশার সাবর্ণ রায়চৌধুরীরা। সেখানে কার্তিকের অবস্থান জমিদার পুত্র বা জমিদার বংশের অগ্রগতির উত্তর পুরুষ রূপে কল্পিত হয়েছে। দেবী লক্ষ্মী ধন-সম্পত্তি, দেবী সরস্বতী ও গণেশ বিদ্যা ও সিদ্ধি দান এবং দেবী দুর্গা বিজয়ের ও শক্তির প্রতীক। শিবসহ সপরিবারের কল্পনা আসলে একান্নবর্তী পরিবারের কল্পনা। ভালো করে পর্যালোচনা করলেও দেখা যাবে জমিদারির প্রধান অঙ্গ রূপে যে যে শাখাগুলি বজায় ছিল তাই তাই দুর্গার সপরিবার মূর্তিতেও পরিলক্ষিত হয়েছে। এই সপরিবারের রূপ বাঁকুড়ার বিষ্ণুপুরের পট, মন্দিরগাত্রে দেখা যায়। সেখানে দুর্গা, শিব, লক্ষ্মী, সরস্বতী, গণেশ ও কার্তিকের সাথে জয়া-বিজয়া, নন্দী-ভৃঙ্গীও বর্তমান। এভাবেই পৌরাণিক দেবী অন্যান্য দেব দেবীর সাথে হয়ে উঠেছেন বাংলার ঘরের আপনজন। লক্ষ্মী ও সরস্বতীও নিজেদের চার হাত ছেড়ে দুই হাতে হয়ে উঠেছেন ঘরের মেয়ে। এভাবেই ভরে উঠেছে বাঙালী দুর্গার আপন সংসারখানা।


প্রারম্ভে ব্যবহৃত ভদ্রকালিকারূপী দেবী দুর্গার ছবি অঙ্কনে লেখক— 


সত্যজিৎ বাগ, আইনজীবী

মোবাইল- 9007202818




Comments

Popular posts from this blog

মাতৃরূপেণ—১২, 'অন্নপূর্ণে সদাপূর্ণে....'—শ্রীজীবশরণ দাস

কালীকথা-৩—পরমব্রহ্ম শবরূপ তাই — ড. অর্ঘ্য দীপ্ত কর

মাতৃরূপেণ—৫, বঙ্গ-মননে পরিবার-সমন্বিতা দুর্গা দর্শন—রাধাবিনোদ ঠাকুর