মাতৃরূপেণ—৮, আনন্দ, আনন্দময়ী ও আনন্দগান—সমীপেষু দাস
- Get link
- X
- Other Apps
আনন্দ, আনন্দময়ী ও আনন্দগান
সমীপেষু দাস
অধ্যাপক, বঙ্গবাসী ইভিনিং কলেজ
পুরাণে কথিত আছে দেবী কৌশিকী মানস-সরোবরে স্নান সেরে হয়েছিলেন মহাগৌরী। তেমনই বর্ষা প্রকৃতির কাজলমাখা রোগ যেন ধুয়ে যায় শরতের কাশের বনের শুভ্রতায়। বাংলার প্রকৃতি মাঠ-ঘাটে লালিত গানের সঙ্গেই আনন্দে মেতে ওঠে। কখনও বসন্তের বাহা পরবের গান, কখনও বা আষাঢ়িয়া ঝুমুর বা কখনও শরতের আগমনী উৎসবের আনন্দগান।
দুর্গাপুজো আর শুধুমাত্র ভক্তি, শ্রদ্ধা, সাধনা, আচার-অনুষ্ঠানেই সীমায়িত নয়; এ যেন ‘দুর্গোৎসব’। তাই যখন আমরা ‘উৎসব’ বলছি, তা তখনই এককের চেয়েও গোষ্ঠীর মঙ্গলচিন্তা এবং আনন্দের কথা অবশ্যই ভাবতে হবে। বর্তমানে এই উৎসবকে কেন্দ্র করে একটি বিজ্ঞাপন ব্যবস্থাও আর্থ-সামাজিক পরিকাঠামোকে মজবুত করেছে। কারিগর, শিল্পীরা যেমন তাদের শিল্পনৈপুণ্যে বিভিন্ন আঙ্গিকে মূর্তি গড়ছেন, তেমনই আলোকসজ্জার সাথে যারা যুক্ত বা যারা মুখরোচক বাঙালি খাবার-দাবারের বিক্রি করে থাকেন বা নতুন পোশাক বানিয়ে থাকেন; তারাও সমানভাবে প্রচারের আলোয় আসছেন। এমনকি এই উৎসবকে কেন্দ্র ক’রেই নিজের পরিবার, আত্মীয়স্বজনের সাথেও মানুষেরা শুধু কয়েকটি দিনের জন্য মিলিত হতে পারে। তাই সবদিক থেকে বিচার করলে বোঝাই যায় যে যেমন একদিকে প্রকৃতির নতুন সাজের প্রকাশ ঘটছে, তেমনই মানুষে-মানুষেও সৌহার্দ্যপূর্ণ আনন্দের পরিবেশ গড়ে উঠছে।
লক্ষ্য বা উপলক্ষ্য যা-ই বলি না কেন, তার কিন্তু মধ্যমণিস্বরূপা দেবী দশভূজা। দক্ষরাজের কন্যা সতী আজও সাবেকি রীতিতে ‘অতসীপুষ্পবর্ণা’ হয়ে প্রাণের মন্দিরে পূজিতা। শিবের ঘরণী হওয়ায় তিনি যেমন শিবানী, তেমনই গিরিরাজের কন্যা হওয়ায় তিনি পার্বতী, আবার অসুরবধের জন্য সেই তিনিই মহিষাসুরমর্দিনী। ব্রাহ্মণ্যবাদী সংস্কৃত উপপুরাণ ‘দেবীভাগবত’-এর অনুসারেই কবি কৃত্তিবাস লিখেছিলেন –
পূজি দুর্গা রঘুপতি করিলেন স্তুতি নতি
বিরচিল চণ্ডীপূজা গান।
এরপর থেকেই শরতের অকালবোধন উৎসব প্রায়ই বাংলা সাহিত্যে অল্প পরিসরে হলেও উঁকি দিয়েছে। খ্রিস্টিয় ১৬শ শতকের কবি মুকুন্দরামের কাব্যেই চণ্ডী দেবীর কালকেতুকে বরদানের প্রসঙ্গে আমরা পাই –
সেই রূপে লোকে তোমা পূজএ আশ্বিনে
এখানে দেবী হলেন ‘অভয়া’। তিনি শুধু ভক্তদলেরই নন; বনের জীবজন্তু, পশুপাখি সকলকেই অভয়দান করেন। মূলতঃ বনদেবী ‘চণ্ডী’-র আখ্যান আখেটিক খণ্ডে প্রাধান্য পেলেও এই দেবীপূজা কালক্রমে শারদীয়ায় পরিণত। যদিও সাধারণতঃ এই সময়ের কাব্যগুলি থেকেই বাংলার দুর্গার কথা প্রচারিত হয়ে থাকে; তবে এর আগেও আরেকটি যাত্রাপথ রয়েছে যেখানে দেবীর সাথেই গানের একটি সম্বন্ধ খুঁজে পাওয়া যায়। সেই ইতিহাস একটু জেনে যাওয়া যাক।
বর্তমানে উপলভ্য পূর্ণাঙ্গ বৈয়াসিক ‘মহাভারত’ -এর বিরাট, ভীষ্ম পর্বে আমরা দুর্গাস্তোত্রের কথা পাই। বিরাটপর্বের সেই অংশে দেখি বলা হয়েছে-
দুর্গাত্তারযসে দুর্গে তত্ত্বং দুর্গা স্মৃতা জনৈঃ ।
কান্তারেষ্ববসন্নানাং মগ্নানাং চ মহার্ণবে ।।
অর্থাৎ কোনও অরণ্যচারী স্ত্রী দেবতার প্রসঙ্গ রয়েছে। আবার, খ্রিস্টিয় ৭ম শতকে বাণভট্টের ‘কাদম্বরী’ কথাকাব্যে রাজা শূদ্রকের রাজসভায় আগত সেই মাতঙ্গকুমারী বা চণ্ডালকন্যার বর্ণনায় রয়েছে সে শ্যামবর্ণা, নীল রঙয়ের কঞ্চুক ও লাল রঙয়ের আঁচল তুলে ঘোমটায় ঢাকা তার গলায় একছড়া মালা এবং কপালে গোরচনা দিয়ে তিলক আঁকা। এমনকি তার সাথে ছিল একটি খাঁচায় থাকা শুকপাখি। তাই কবি তাকে উপমা দিয়েছেন ব্যাধবেশিনী ভবানী-র রূপে – “কিরাতবেষামিব ভবানীম্ ”।
এই বর্ণনা আমরা কিন্তু দশমহাবিদ্যার অন্তর্গত মাতঙ্গীর রূপের সাথে মেলাতে পারি। সেই দেবী শ্যামাঙ্গী, চারহাতে পাশ, অঙ্কুশ, তলোয়ার ও খেটক ধ’রে আছেন-
শ্যামাঙ্গীং শশিশেখরাং ত্রিনযনাং রত্নসিংহাসনস্থিতাম্ ।
বেদৈঃ বাহুদণ্ডৈরসিখেটকপাশাঙ্কুশধারিণীম্ ।।
নানারত্নবিভূষিতাং ত্রিজগতাং ধাত্রীং স্ফুরল্লোচনাম্ ।
বন্দে পদ্মপাদযুগলাং মাতঙ্গীমব্জাননাম্ ।।
আবার, এই দেবীর অন্যান্য বিবরণ-ও পাই। যেমন ‘শ্যামলাদণ্ডক’-এ তিনি শুকপাখির সাথে খেলা করেন এবং মাণিক্যবীণা নিয়ে আছেন। পাশ, অঙ্কুশ এবং মাণিক্য ভারতীয় জ্যোতির্বিজ্ঞান অনুসারে দণ্ড বা সূর্যের প্রতীক এবং অন্যদিকে শুকপাখি বা বীণা বুধের অনুষঙ্গে থাকে। বাংলার আশ্বিন মাসে সূর্য বুধের রাশি কন্যা-তে অবস্থান করে। ফলে সূর্য ও বুধের একটি যোগসূত্র উভয় ক্ষেত্রেই রয়েছে এবং বীণার অনুষঙ্গ কোথাও না কোথাও যেন দেবীর সাথে গানকে যুক্ত করে।
কিরাত, ব্যাধ এগুলি সমপর্যায়ের শব্দ। বাণভট্টের উক্ত কাব্যেই কিরাতদের জীবনচর্যা সম্পর্কে বলা হয়েছে সেই দুর্ধর্ষ জাতির দলপতি হতেন মাতঙ্গ এবং তাদের আরাধ্য দেবী ছিলেন কালী। সেই দেবীকে নরমাংস নিবেদন করতেন। ফলে এই কাব্যের চণ্ডালিনীর সাথে দেবী মাতঙ্গীর একটি মিল পাই। এমনকি তন্ত্রে এই দেবীকে ‘উচ্ছিষ্টা চণ্ডালিনী’-ও বলা হয়ে থাকে। ‘বাংলা মঙ্গলকাব্যের ইতিহাস’-এ ডঃ আশুতোষ ভট্টাচার্য জানিয়েছেন-
“ চণ্ডী মূলত ব্যাধজাতিরই এবং পশুর অধিষ্ঠাত্রী দেবী। মুণ্ডাজাতির লোক ব্যাধ বৃত্তির দ্বারা জীবিকা নির্বাহ করিয়া থাকে, সেইজন্য তাহাদের মধ্যে এই দেবতার প্রভাব খুবই ব্যাপক। ”
আবার ১৫শ শতকের রাজা গণেশের প্রবর্তিত মুদ্রায় ‘চণ্ডীচরণপরাযণস্য’ এই শব্দ পাওয়া যায় এবং প্রায় এই সময়েই রচিত ‘কৃত্তিবাসী রামায়ণ’ -এও ‘চণ্ডীপূজা’ শব্দ থেকেই বোঝা যায় শারদীয় দুর্গোৎসবের দেবী দুর্গা ও চণ্ডী একীভূত হয়েছে এবং এখনও পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন জেলায় ( নদিয়ার বীরনগর, হুগলির আঁটপুর ) চণ্ডীমণ্ডপ রয়েছে যা কিন্তু দুর্গাপুজোর জন্যই ব্যবহৃত হয়। বিজয়গুপ্তের ‘পদ্মাপুরাণ’ কাব্যে শিবের স্ত্রী যখন কুপিত, তখন তিনি ‘চণ্ডী’; আবার শিব তার মানভঞ্জনের জন্যই তাকে সুন্দর রূপের দোহাই দিয়ে বলে ‘গৌরী’। অতএব ‘চণ্ডীমঙ্গল’ কাব্যের দেবীই পরবর্তীতে কখনও হয়েছেন ‘উমা’ বা ‘গৌরী’।
১৮শ শতকের প্রথমার্ধে ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে বর্গীদের আক্রমণ ঘটে। তখন মুর্শিদাবাদ ও নদিয়া সুবে-বাংলার দুটি শক্তিশালী রাজনৈতিক অঞ্চল। নদিয়ার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সমসাময়িক দু’জন কবি হলেন রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র এবং রামপ্রসাদ সেন। এই সময়ের আগে পর্যন্ত রাঢ় বাংলায় মনসামঙ্গল, চণ্ডীমঙ্গলের ধারা বেশ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে। কবি ভারতচন্দ্র একটু নতুন আঙ্গিকে রচনা করলেন ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্য। পূর্বোক্ত মঙ্গলকাব্যগুলি আটচালা চণ্ডীমণ্ডপে কথক, গায়নদের দ্বারা পালাগান, নাটগীতের আকারে পরিবেশিত হতো কিন্তু ভারতচন্দ্রের কাব্য ছিল মূলতঃ সাহিত্য। এই প্রসঙ্গেই দীনেশচন্দ্র সেন ‘বঙ্গভাষা ও সাহিত্য’-এর দ্বিতীয় খণ্ডে বলেছেন –
“ বস্তুতঃ বাঙ্গালী কবিতা এখন আর ‘কৃষকের গান’ নহে; এখন বঙ্গভাষা স্বভাবসুন্দরী লজ্জাবতী পল্লীবধূটির মত শুধু পল্লীকবির আদরের জিনিষ নহে। ”
‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যের শিবনিন্দার অংশে মেনকার খেদ চোখে পড়ে-
আমার উমা মেয়ের চূড়া ।
ভাঙ্গড় পাগল ওই লো বুড়া ।।
আবার যে সাধক কবির জন্য আজ বাঙালি আগমনী গানকে বিশেষ নজরে সম্মান জানায়, সেই রামপ্রসাদী শাক্ত পদাবলিতেও দুর্গাকেন্দ্রিক পদগুলিতে এই একই ছবি ধরা দেয়। ‘এবার আমার উমা এলে’ গানেও মেনকার হয়ে রামপ্রসাদ সেন বলেন –
এবার মায়ে-ঝিয়ে করবো ঝগড়া, জামাই বলে মানবো না
আজকের সময়ে দাঁড়িয়ে এই দুর্গাপুজো বাঙালির কাছে এক পরম আনন্দ-উৎসব হলেও রামপ্রসাদী পদাবলিতে গিরিরাজের কন্যা উমা বাপের বাড়িতে মাত্র তিনদিনের জন্য আসলেও মা মেনকা যেন তার বিদায়যন্ত্রণাকেই বেশি করে ভাবে। তাই উমার আগমনে যত না আনন্দিত, ততোধিক ব্যথিত কৈলাসে ফিরে যাওয়ার কথা চিন্তা ক’রে। রামপ্রসাদ সেনের এই গানের সুর ও রস আপামর বাঙালিকে অত্যন্ত স্পর্শ করে গেছে। তাই আজও আমরা ‘মাতৃরূপেণ’ ভাবকল্পের চেয়েও বিশ্বাসে ‘কন্যারূপেণ’ স্বরূপেই আপন করে নিই দুর্গাকে। তাই বিজয়া দশমীর দিনে বিসর্জনের মন্ত্রোচ্চারণে পূজারির চোখে জল আসে। তবুও ক্ষণিকের সুখস্মৃতিতে তা বড়োই মধুর; তাই তিনি ‘আনন্দময়ী’। ‘আনন্দ’ শব্দটির ভারতীয় বেদান্ত দর্শনের পরিপ্রেক্ষিতে অন্য অর্থ থাকলেও এবং দেবীকে ‘ব্রহ্মময়ী’ বলা হলেও সাধারণ প্রচলিত জীবনযাত্রার সাথেও নামটি খুবই ঘনিষ্ঠভাবে সমাদর পেয়েছে।
কমলাকান্ত ভট্টাচার্যের পদেও মোটামুটি সেই একই ভাবের পুনরাবৃত্তি দেখা যায়-
একে সতীনের জ্বালা, না সহে অবলা, যাতনা প্রাণে কত সয়েছে।
বা তাঁরই একটি গানের দুটি কথা আজ প্রবাদ বাক্যে পরিণত – “ হরিষে বিষাদে ”।
পরের শতকেই অর্থাৎ ১৯শ শতকে বাঙালির কবিগানের চর্চা যথেষ্ট খ্যাতি পায়। সুতানুটি-বাগবাজার অঞ্চলে হঠাৎ-রাজা হয়ে ওঠা এক শ্রেণির মানুষেরা হয়ে ওঠে ‘বাবু’। সেই সেকালের ‘দুর্গোৎসব’-এ কবিগানের লড়াই ও ‘বিদ্যাসুন্দর’ পালা-কে তৎকালীন সংস্কৃতি থেকে কোনওভাবেই বাদ দিতে পারিনা। ঈশ্বর গুপ্ত, প্রফুল্লচন্দ্র পাল, দীনেশচন্দ্র সিংহ এনারা কবিগান নিয়ে যেভাবে গবেষণা করেছেন, তাতে আমরা জানতে পারি যে কবিগানের পাঁচটি পর্যায় ছিলো। তার মধ্যে একটি হলো ‘ভবানী বিষয়ক পদ’ বা ‘মালসী’। এই ‘মালসী’ হলো মালবশ্রী রাগে গাওয়া গান। দ্বিজ মাধবের ‘মঙ্গলচণ্ডীর গীত’-এর পঞ্চম পালায় কালকেতুর দশভূজার স্তুতি করেছে এই রাগে। আসলে এটি শরতেরই গান। বর্তমানে লুপ্ত এই গান এক সময়ে যথেষ্ট লোকপ্রিয় ছিলো। তবে এ সম্পর্কে বিশদে কিছু বলা যাবেনা। তবুও ধরাই যায় এখানে শাক্ত দেবীর স্তুতি গাওয়া হতো। যেমন হ্যান্সম্যান অ্যান্থনির “জয় যোগেন্দ্রজায়া মহামায়া”। এছাড়াও দাশরথি রায়ের পাঁচালিতেও বেশ কিছু আগমনী গান পাই। এর পাশাপাশি তখন নাট্যচর্চা-ও কলিকাতাকে প্রভাবিত করেছিলো। গিরিশচন্দ্র ঘোষের ‘আগমনী’ গীতিনাট্য (১৮৭৭)-এও বেশ কিছু আগমনী বিষয়ে গান পাই। যেমন তৃতীয় দৃশ্যের –
ওমা কেমন করে পরের ঘরে ছিলে উমা
এই গীতিনাট্যে আমরা সরাসরি উমা চরিত্রটিকে পাই। রামপ্রসাদী গানে মেনকা ও গিরিরাজের চরিত্র আসলেও উমার সংলাপে উনি সেভাবে গান রচনা করেননি। উমা সেখানে নেপথ্যে। তাকে ঘিরেই যতো আনন্দ অথচ স্বয়ং অনুপস্থিত গানগুলিতে।
এরপরেই বাংলা সাহিত্যে ঘটেছে পালাবদল। আজ আমরা শরৎকাল আসতেই রাস্তায়-ঘাটে বিভিন্ন বিজ্ঞাপনে, গণমাধ্যমে নীল আকাশ, সাদা ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ, কাশফুল, শিউলি ফুল, ঢাকের কাঠি এই প্রতীকী চিহ্নগুলি দেখতে পাই অথচ ১৯শ শতক পর্যন্ত উমা-আগমনের আনন্দগানে এই পটভূমিকা নেই। এই প্রকৃতির উৎসবকে চিনিয়ে দিয়েছেন বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর। তাঁর গানে আমরা পাই ‘শারদলক্ষ্মী’ বা ‘শারদসুন্দরী’। এমনকি তিনি “দেখো দেখো, দেখো, শুকতারা আঁখি মেলি চায়” গানটিতে ‘আগমনী’ শব্দেরও ব্যবহার করেছেন কিন্তু তা নৈসর্গিক সৌন্দর্যের আগমনবার্তা।
শরতে আজ কোন্ অতিথি এল প্রাণের দ্বারে
আনন্দগান গা রে হৃদয়, আনন্দগান গা রে ।
এই গানে তিনি জনগণকেই প্রকৃতির আবাহনের মঙ্গলগান গাইতে বলেছেন। ফলে আগমনী গানের ধারার বিবর্তনে রবীন্দ্রনাথ একটি স্বতন্ত্র ধারা। এখানে সেই শরতের সৌন্দর্যময়ী প্রকৃতির অমলসুন্দর রূপের আগমনের বন্দনা।
রবীন্দ্রনাথের পরবর্তী সময়ে আমরা তিন কবিকে একসাথে পাই - দ্বিজেন্দ্রলাল-অতুলপ্রসাদ-রজনীকান্ত। রজনীকান্ত সেনের ‘আনন্দময়ী’ কাব্য (১৯১০) এই আগমনী ও বিজয়া পর্বের গানেরই সংকলন। এই কাব্যগ্রন্থ সম্পর্কে সারদাচরণ মিত্র বলেছেন –
“ প্রথমে আগমনীর আনন্দ, শেষে বিজয়া এবং তৎপরে পুরুষ-প্রকৃতির মিলন; ”
এই কাব্যের একটি গানের কথা না বললেই নয়, সেটি হলো মেনকার প্রতিবেশিনীদের সংলাপের গান “ গা তোল, গা তোল গিরিরাণি ! ” গানটি। এখানে উমা হয়েছে ‘মা’। মেনকা যেমন তার সন্তানকে ভুলতে পারেনা; তেমনই উমা-ও কিন্তু আনন্দে আত্মহারা হয়ে তার সন্তান কার্তিক ও গণেশকে উপেক্ষা করেনি। আমরা একচালে সপরিবারে দুর্গাপুজোর সাথে সকলেই পরিচিত। তাই এই গানে কন্যাভাবের চেয়ে মাতৃ্ত্বের ভাষা বেশি প্রকাশ পেয়েছে।
বাঙালির বীর বিপ্লবীদের দুর্গাপুজো-ও একটি ইতিহাসের অধ্যায়। কলকাতার বিখ্যাত সিমলা ব্যায়াম সমিতি-র পুজো ১৯২৬ সালে অতীন্দ্রনাথ বসুর উদ্যোগে ও উৎসাহে শুরু হয়। সেই বছরেই মাণিকতলায় কংগ্রেস দলের নেতাদের উদ্যোগেই পুজো হয়েছিলো এবং ১৯৩৮-৩৯ সালে নেতাজি কুমোরটুলি সার্বজনীন দুর্গোৎসব কমিটি-র সভাপতি ছিলেন। এমনই একজন কবি ও গীতিকার হলেন বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর “এবার নবীন মন্ত্রে” গানে যেমন দেবী জাতি-ধর্ম-বর্ণের ঊর্ধে পৌঁছেছেন, তেমনই ১৯২২ সালে প্রকাশিত ‘আনন্দময়ীর আগমনে’ কবিতাও এক অন্য বাণী শোনায় –
আর কতকাল থাকবি বেটী মাটির ঢেলার মূর্তি আড়াল ?
স্বর্গ যে আজ জয় করেছে অত্যাচারী শক্তি চাঁড়াল ।
তিনি মৃন্ময়ী-কেই চিন্ময়ী করতে চেয়েছেন। তাই স্বর্গ থেকে মর্ত্যে আহ্বান করেছেন দেবীকে। এই কাব্য তাঁকে সেই সময়ে রাজরোষে পতিত করলেও আজ তা এনে দিয়েছে স্বাতন্ত্র্যের আগমনী সুর। তাই এখানে দেবী আবারও ‘আনন্দময়ী’।
শেষে আমাদের বলতেই হয় সেই কালজয়ী প্রভাতী অনুষ্ঠানের কথা। ‘আকাশবাণী’ (কলকাতা) থেকে সম্প্রচারিত ‘মহিষাসুরমর্দিনী’ অনুষ্ঠানে বাণীকুমারের রচনা, পঙ্কজ মল্লিকের সুর এবং অবশ্যই বীরেন্দ্রকৃষ্ণ ভদ্রের উদাত্ত কণ্ঠস্বর আজও আমাদের মনে ও প্রাণে এক নতুন শক্তি এনে দেয়। এতক্ষণ পর্যন্ত আমরা বিভিন্ন ধারার আগমনী গানের কথা তুলে ধরেছি। সেখানে কখনও প্রকৃতির রূপবর্ণনা, দেবীর স্তুতিপাঠ, কখনও বল্লালী প্রথায় কৌলীন্য বজায় রাখতে মেয়েদের অল্প বয়সে শ্বশুরবাড়িতে পাঠানোর যন্ত্রণা আবার কখনও বিপ্লবের নিনাদ।এই সমস্ত ধারাগুলিরই যেমন সমাবেশ পাই এই অনুষ্ঠানে। যেমন ভৈরবী রাগের চলনে “বাজলো তোমার আলোর বেণু” কিছুটা রাবীন্দ্রিক ভাবকে মনে করায়; আবার “নমো চণ্ডী” বা “তব অচিন্ত্য” গানটির কথা মঙ্গলকাব্য বা কবিগানের মেজাজকে ফিরিয়ে আনে; আবার “জাগো, তুমি জাগো, জাগো দুর্গা, জাগো দশপ্রহরণধারিণী” গানটি জাগরণী শক্তির নব উদ্ভাসনের শাশ্বত শুভোদয় এবং আনন্দনাদের নান্দীপাঠ।
পটচিত্র-অঙ্কনে : বাহাদুর চিত্রকর ( পশ্চিম মেদিনীপুর)
- Get link
- X
- Other Apps
Comments
Post a Comment