রবীন্দ্র-আলোকে ললিত ভারতী—সমীপেষু দাস

Image
  রবীন্দ্র-আলোকে ললিত ভারতী কাব্যসরস্বতী কোনো মন্দিরের বন্দিনী দেবতা নন                                                                                                       ( মধুমঞ্জরি, বনবাণী )                        রবীন্দ্রনাথ কাব্য ও সংগীতকে কখনওই পৃথক ব’লে ভাবতেন না। প্রথম জীবনের তাঁর কাব্যগুলির নামকরণ-ই তার যথাযথ প্রমাণ – সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল  ইত্যাদি। এমনকি যে কাব্যের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান; তা-ও গীতাঞ্জলি। তাঁর রচিত অসংখ্য কবিতা-ই গানের রূপ পেয়েছে। ব্যক্তিজীবনে তিনি তাঁর কাব্যরচনার প্রেয়সীরূপে পেয়েছিলেন তাঁর ‘নতুন বৌঠান’ তথা কাদম্বরী দেবী-কে। তিনি যখন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে আসেন; তখন বয়সে তিনি বালিকা। তাই সেই ছবিই পরবর্তীত...

মাতৃরূপেণ—৯, যজ্ঞে 'মাতৃরূপেণ' নারীর অধিকার—রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক

  যজ্ঞে 'মাতৃরূপেণ' নারীর অধিকার 

রাধাবিনোদিনী বিন্তি বণিক

দমদম পার্ক। কলকাতা।   

             

                          শ্রীমদ্ ভাগবত মহাপুরাণের একটি ঘটনা প্রথমে সংক্ষেপে জানি , আসুন। ভাগবতের  দশম স্কন্ধের  ত্রয়োবিংশ অধ্যায়। যমুনার তটে ব্রজেন্দ্রনন্দন শ্রীকৃষ্ণ তাঁর দাদা বলরাম ও অন্যান্য গোপসখাদের  নিয়ে বসে আছেন  তাঁদের গোবৎসগুলোকে  পাশের  উপবনের মধ্যে চড়তে দিয়ে ।মধ্যাহ্নকাল তখন। গোপবালকরা বললেন, "কৃষ্ণসখা ,খুব ক্ষিদে পেয়েছে । ক্ষিদেতে কষ্ট পাচ্ছি । কোনোভাবে ক্ষিদে মেটাবার কোন উপায় করো না।" শ্রীকৃষ্ণ-বলরাম বললেন , "এক কাজ করো ।এখান থেকে কিছু দূরে বেদবাদী ব্রাহ্মণরা স্বর্গ কামনায় আঙ্গিরস নামে এক যজ্ঞের আয়োজন করেছেন। সেখানে গিয়ে আমাদের নাম করে কিছু অন্ন চেয়ে আনো।"      

               কয়েকজন গেলেন। ব্রাহ্মণদের প্রণাম  জানিয়ে কৃষ্ণ-বলরামের নাম করে অন্ন প্রার্থনা করলেন। কিন্তু ব্রাহ্মণরা তাঁদের কথায় কোন ভ্রুক্ষেপ করলেন না।নিজেদের জ্ঞানবৃদ্ধ বলে মনে করা সেইসব অহংকারী ব্রাহ্মণরা হ্যাঁ বা না ,কিছুই না বলে মৌন থাকলেন।গোপবালকদের ভীষণ তাচ্ছিল্য করে নিজেদের যজ্ঞের কাজে মগ্ন থাকলেন। অনেকক্ষণ অপেক্ষার পর অন্ন পাবার আর কোন আশার আলো না দেখে ফিরে এলেন গোপেরা মলিন মনে। কী কী ঘটেছে সবই তাঁরা এসে বললেন কৃষ্ণ-বলরামকে।  কৃষ্ণ-বলরাম বললেন, "বেশ , আরো একবার কষ্ট করে যাও সেখানে তোমরা ।আর ,এবার ব্রাহ্মণ পত্নীদের  কাছে অন্ন চাইবে আমাদের নাম করে ।" তাই করলেন  উপেক্ষিত গোপবালকেরা। কাছাকাছিই কোথাও  শ্রীকৃষ্ণ আছেন জেনে সেইসব ব্রাহ্মণ পত্নীরা তাঁকে দর্শন করার জন্য উতলা হয়ে উঠলেন । চর্ব্য-চোষ্য-লেহ্য-পেয় চার রকম সুস্বাদু খাবার সাজিয়ে নিয়ে নিজেরাই চলে এলেন কৃষ্ণ-বলরামকে  ভোজন করাতে। কোনো রকম কোনো সংশয় মনে না রেখে ,সমাজ-সংসার, পতি-পুত্র সকলকে উপেক্ষা করে যজ্ঞস্থান ছেড়ে কৃষ্ণের জন্য অর্ঘ্য নিয়ে বেড়িয়ে এলেন । যেমন করে নদী সব রকম বাধাকে ঠেলে সমুদ্রে মিশে যায় তেমন করেই তাঁরাও এলেন পরমপুরুষের সঙ্গে মিলিত হতে।যে ভগবানকে পাবার জন্য এত যাগ-যজ্ঞ ,অর্চন-বন্দন তিনি স্বয়ং এসেছেন নৈবেদ্য নিতে!  তাঁর কাছে তো যেতেই হবে তাই সব প্রতিকূলতাকে তুচ্ছ করে। তা সে পরিণামে যাই হোক না কেন সেটা পরবর্তীতে বিবেচ্য। সকল গোপসখা সমেত কৃষ্ণ-বলরাম আহার করলেন পরম পরিতৃপ্ত হয়ে। এখন সর্বান্তর্যামী, সর্ববুদ্ধিসাক্ষী ভগবান শ্রীকৃষ্ণ তো সবই জানেন  ব্রাহ্মণ পত্নীদের মনের ভাষা। তিনি প্রশংসা, অভিবাদন করলেন তাঁদের প্রেমভক্তির। 

"তদ্ যাত দেবযাজনং পতয়ো বো দ্বিজাতয়ঃ।

স্বসত্রং পারয়িষ্যন্তি যুষ্মাভির্গৃহমেধিনঃ।।" 

                                (ভা-১০/২৩/২৮)

তারপর  শ্রীকৃষ্ণ বললেন, " এখন আপনারা যজ্ঞশালায় ফিরে যান ।আপনাদের পতিরা গৃহস্থ ব্রাহ্মণ। আপনারা গেলে তবেই তাঁরা আপনাদের সঙ্গে মিলিত হয়ে নিজেদের যজ্ঞ সমাপন করতে পারবেন।"

                     ব্রাহ্মণ পত্নীরা রাজী হলেন না ফিরে যেতে। তাঁরা ভাবলেন গৃহে আর তাঁদের স্থান হবে না , তাঁরা স্বামী পরিত্যক্তা হবেন এই হঠকারি ভাবে যজ্ঞস্থান ছেড়ে চলে আসায়। কৃষ্ণচরণে তাঁরা আত্মনিবেদন করতে চাইলেন। শ্রীকৃষ্ণ বোঝালেন, " আপনারা নিশ্চিন্তে থাকুন। পরিবারের কেউ আপনাদের দোষদর্শন করবে না। আপনারা আমার সাথে নিত্যযোগে যুক্ত হয়ে গেছেন। আমার থেকে আপনাদের আর বিচ্ছেদ হবে না। কেবল শারীরিক ভাবে আপনারা সংসারে থাকবেন। কারণ, আপনাদের সেখানে প্রয়োজন।" 

" ইত্যুক্তা দ্বিজপত্ন্যাস্তা যজ্ঞবাটং পুনর্গতাঃ।

তে চানসূয়বঃ স্বাভিঃ স্ত্রীভিঃ সত্রয়পারয়ণ।"

                        (ভা:১০/২৩/৩৩)

ভগবানের কথা সুসত্য জেনে গৃহে ফিরে গেলেন ব্রাহ্মণীরা। আর ফিরে গিয়ে সম্পন্ন করলেন যজ্ঞ।

                 'শ্রীমদ্ ভাগবত মহাপুরাণ' , যা শ্রীভগবানের শব্দময় রূপ , যা অভিন্ন কৃষ্ণ কলেবর ----সেই মহাগ্রন্থের যে শ্লোকদুটি লিখলাম তাতে দেখা যাচ্ছে যে ভগবান নিজের মুখে বলছেন যজ্ঞে দ্বিজপত্নী তথা স্ত্রী-জাতির প্রয়োজন। তাঁরা গেলে তবেই যজ্ঞ সম্পূর্ণ করা সম্ভব হবে, অন্যথায় হবে না । আর , তাই যজ্ঞপত্নীরা ফিরে গিয়ে যজ্ঞ সম্পন্ন করলেন। অতএব, সাড়ে পাঁচ হাজার বছর আগের দ্বাপরযুগেও বেদবাদী ব্রাহ্মণদের সাথে মহিলারা যজ্ঞবেদীতে বসতেন, আহুতি দিতেন, বেদমন্ত্র উচ্চারণ করতেন , এবং তা স্বয়ং ভগবানের অবতীর্ণ কালের সময়েই--- এ প্রমাণ কিন্তু পাওয়া গেল।

           আবার , ত্রেতাযুগে রামায়ণের কালেও পতির সঙ্গে পত্নীর যজ্ঞে হব্য দেবার অধিকার ছিল। রামায়ণে দেখা যায় রাণী কৌশল্যা ছিলেন দশরথের যজ্ঞের অংশভাগিনী। সীতার পাতাল প্রবেশের পর রামচন্দ্র যখন যজ্ঞ করেন , তখন অংশগ্রহণকারিণীরূপে  স্ত্রী-সীতার সোনার মূর্তি গড়ে আনা হয় সীতা অবর্তমান থাকায়।


           নারীরা যে তাঁদের পতিদের সঙ্গে মিলিত হয়ে যজ্ঞ করতেন তার প্রমাণ পাওয়া যায় ঋক্ বেদের বিভিন্ন সূত্রে ।যেমন--

১) " হে ইন্দ্র তোমার সেবক এবং পাপদ্বেষী যজমান দম্পতি তোমার তৃপ্তির অভিলাষে অধিকপরিমান হব্য দান করে তোমার উদ্দেশ্যে বহু সংখ্যক গোধন লাভের জন্য যজ্ঞ বিস্তার করেছে।" ( ১/১৩১/৩)

২) "পরিণীত দম্পতি একত্রে তোমাকে প্রচুর হব্য দান করেছে।" (৫/৪৩/১৫)

          বস্তুতঃ , পত্যুর্নো যজ্ঞসংযোগে (পাণিনির সূত্র ৪/১/৩৩) --পত্নী ছাড়া যজ্ঞ সম্পন্ন হয় না । পত্নীহীনদের আহুতি ভগবান গ্রহণ করেন না।

প্রতিটি যজ্ঞে 'পত্নী সংযাজ' বলে একটি অংশ থাকে, তাতে বেদের মন্ত্র উচ্চারণ করে নির্দিষ্ট ধর্মীয় ক্রিয়া সম্পাদন করতে হয় নারীদের। পালয়িত্রী যিনি তিনি পত্নী। পত্নীর উপস্থিতির পরই পতী যজ্ঞ সম্পূর্ণ করতে পারে।পুরুষের অর্ধাঙ্গিনী একারণেই বলা হয় পত্নীদের ।


কিন্তু, যাগ বা যজ্ঞ কাকে বলে ?যজ্ঞ  একটি বাহ্যিক অনুষ্ঠান ; দেবতার উদ্দেশ্যে আগুনে ঘৃত-আহুতি দান হল যজ্ঞের বাইরের দৃষ্ট রূপ। আহুতি অর্থাৎ আত্মাহুতি, নিজ আত্মাকে দান কোন মহৎ কাজে। কোন মহৎ কর্ম করার জন্য সেই কর্মের উদ্দিষ্ট দেবতাকে আহ্বান বা আমন্ত্রণ জানানো , নিজ আত্মাকে উৎসর্গ করে। ঘৃত বা ঘি হল সত্ত্ব গুণের প্রতীক। দুধকে ক্রমাগত তাপ দিয়ে দুধের সকল মলিনতা বের করে দিয়ে দুধের যে চরম উৎকৃষ্ট বস্তু পড়ে থাকে সেটাই ঘৃত। ঘৃত শব্দের অর্থ জ্যোতির ধারা । আগুনে ঘৃত দিয়ে অর্থাৎ সত্ত্ব গুণময় হয়ে ,দীপ্ত হয়ে আমন্ত্রণ জানানো হয়  অভিলষিত দেবতাকে। আমন্ত্রণ করার ফলে কি পাওয়া যায় ? 

"দেবান্ ভাবয়তানেন তে দেবা ভাবয়ন্তু বঃ।

পরস্পরং ভাবয়ন্তঃ শ্রেয়ঃ পরমবাপস্যথ।।"

                      (গীতা--৩/১১)

               শ্রীভগবান কৃষ্ণ গীতায় বলেছেন--যজ্ঞ দ্বারা তোমরা দেবগণকে সংবর্ধনা করো।দেবগণও তোমাদিগকে সংবর্ধনা করুন ।এইরূপে পরস্পরের সংবর্ধনা দ্বারা মঙ্গল লাভ করবে । 


এবার যজ্ঞ সম্পন্ন করতে কি প্রয়োজন ? যজ্ঞের 'হোতা' অর্থাৎ 'পুরোহিত' প্রয়োজন  পুরোভাগে বা সম্মুখে যিনি হিত স্থাপিত করেন তিনি পুরোহিত । যদি আরও গভীরে ভাবা যায় যে, এ সংসারে কোন মানুষের জীবনে সর্বপ্রথম এবং সর্বোৎকৃষ্ট হিতসাধন কে করেন?   উত্তর---' মা '। অতএব, জগৎ সংসারে বড় পুরোহিত যিনি, তিনি একজন স্ত্রীলোক ,একজন নারী ।তাহলে যজ্ঞ কর্মে বা পৌরোহিত্য কর্মে নারীরা  যদি এগিয়ে আসেন , সক্রিয় ভাবে অংশগ্রহণ করেন তাহলে অনৈতিক কিছু ঘটলো কী? 


            বৈদিক যুগে কিন্তু নারীজাতির অনেক উচ্চস্থান ছিল।তাঁরা পুরুষদের মতই সমান সম্মান, সমান মর্যাদা ,সমান গুরুত্ব পেতেন। বা বলা ভাল, আরও বেশী সম্মান তাঁদেরকে দেওয়া হত। কারণ , প্রতিটি নারীকে লক্ষ্মী বা শ্রী দেবী রূপে ভাবা হত। নারীবধ অতি পাপকার্য বলে মানা হত।আর্য যুগে উপনয়ন সংস্কার সহ অন্যান্য ক্রিয়াকর্ম যা পুরুষদের করা  হত, নারীদের ক্ষেত্রেও করা হত। ব্রহ্মজ্ঞান পূর্ণা বহু নারীর নাম বেদে পাওয়া যায় । তাঁরা বেদমন্ত্র উচ্চারণ করতেন, আহুতি দিতেন, যাগ-যজ্ঞ করতেন।


ঋকবেদের ৮/৯১ সূক্তের শেষ মন্ত্রে ঋষি অপালা (স্ত্রী জাতি) আহুতি দিতে গিয়ে নিজের কথা নিজেই বলিষ্ঠ কন্ঠে উচ্চারণ করছেন দ্বিধাহীন ভাবে ।বলছেন--" ইন্দ্র আমাকে সূর্যের মত রূপ দিয়ে আত্মসাৎ করেছেন।" ভাবা যায়,  তাহলে নারীদের কতখানি অগ্রাধিকার দেওয়া হত! 

ঋকবেদের যে সূক্তগুলিতে মহিলা ঋষিদের নাম পাওয়া যায় সেগুলি হল-- 

১) ১ম মন্ডল ১৭৯ সূক্ত, ঋষি লোপামুদ্রার নাম।

২) ৫ম মন্ডল ২৮ সূক্ত,     ,,      বিশ্ববারার  ,,। 

৩) ৮ম মন্ডল ৯৬ সূক্ত,      ,,       অপালার   ,,।

৪) ১০ম মন্ডল ৪০সূক্ত ,    ,,        ঘোষার      ,,।

৫) ১০ম মন্ডল ৮৫ সূক্ত      ,,         সূর্যার    ,, ।

৬) ১০ম মন্ডল ১২৫ সূক্ত,    ,,        বাক্-এর   ,, ।

৭) ১০ম মন্ডল ১৪৫ সূক্ত,    ,,        ইন্দ্রাণীর  ,, ।

৮) ১০ম মন্ডল ১৫১সূক্ত,     ,,         শ্রদ্ধার     ,,।

৯) ১০ম মন্ডল ১৮৯ সূক্ত,     ,,      সার্পরাজ্ঞীর ,, ।

        শৌনককৃত বৃহদ্দেবতায় সমগ্র বেদের নারী ঋষিদের একটি তালিকা পাওয়া যায়---

" ঘোষা গোধা বিশ্ববারা অপালোপনিষন্নিষৎ।

ব্রহ্মজায়া জহুর্নাম অগস্ত্যস্য স্বসাদিতিঃ।।

ইন্দ্রাণী চেন্দ্রমাতা চ সরমা সোমশোর্বশী।

লোপামুদ্রা চ নদ্যশ্চ যমী নারী চ শশ্বতী।

শ্রীর্লাক্ষা সার্পরাজ্ঞী বাকৃ শ্রদ্ধা মেধা চ দক্ষিণা।

রাত্রী সূর্যা চ সাবিত্রী ব্রহ্মবাদিন্য ঈরিতাঃ।। "

                                    ( ২/৮২-৮৪)

ঘোষা ,গোধা, বিশ্ববারা,অপালা,উপনিষদ্ নিষদ্, ব্রহ্মজায়া যাঁর নাম জুহু , অগস্ত্যের ভগিনী, অদিতি , ইন্দ্রাণী , ইন্দ্রের মাতা, সরমা ,সোমশা,উর্বশী, লোপামুদ্রা আর নদীসমূহ ,যমী , তথা পত্নী শশ্বতী, শ্রী ,লাক্ষা , সার্পরাজ্ঞী ,বাচ্ ,শ্রদ্ধা, মেধা,দক্ষিণা ,রাত্রী , সূর্যা এবং সাবিত্রী।   

         (সূত্র: হিন্দু ধর্মের সারতত্ত্ব, ড. রামকৃষ্ণ শাস্ত্রী)

           

  ঋগ্বেদ রচিত হয় আনুমানিক খ্রীঃপূঃ দ্বাদশ শতকে। এই বেদে পাওয়া যায় নারী যেমন তত্ত্বালোচনা করছেন,কাব্যরচনা করছেন তেমন আবার পুরুষের সমতালে অস্ত্রবিদ্যায় পারদর্শী হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রেও অবতীর্ণ হচ্ছেন। এসময় নারীর দেহশ্রী বা তাঁর  পৈতৃক সম্পত্তি বা বংশমর্যাদা দেখে পাত্রী নির্বাচন করা হত না। পাত্রীর বুদ্ধির প্রখরতা ও জ্ঞানের গভীরতাই বিচার্য বিষয় ছিল । এমনকী নারীদের পতি নির্বাচনে স্বাধীনতা দিতে তো রাজবংশে স্বয়ম্বর সভার আয়োজনও হত। সামবেদ গাওয়ায় নারীদের অধিকার ছিল। কিন্তু , দশম শতাব্দীর পর থেকে মূলতঃ সমাজে নারীদের অধিকার বা স্বতন্ত্রতা কমতে থাকে। আর তাই , এসময়ে রচিত অথর্ববেদে কিন্তু আর নারীদের সেই উচ্চাসন দেখতে পাওয়া যায় না ।



  এখন , প্রশ্ন আসে তবে কেন নারীরা যজ্ঞ করার সেই অধিকার হারালেন? কেন বেদমন্ত্র উচ্চারণ, শালগ্রাম শিলা স্পর্শ থেকে ব্রাত্য হলেন?   

        

                  প্রাচীন ভারতে আর্যরা অনার্যদের শূদ্র ,অসুর বা দস্যু বলতো। বেদ পাঠে এবং শ্রবণে এই শূদ্রদের কোন প্রকার  অধিকার ছিল না।বলা হয়েছিল যে,এর বিরুদ্ধাচরণ করলে তাদের  জিহ্বা কেটে নেওয়া  হবে,কানের ভিতর গরম সীসা ঢেলে দেওয়া হবে ।বর্তমানে আমরা যাদের শূদ্র বলে সমাজে বাস করতে দেখি , তারা কিন্তু সেই শূদ্র নয়। পরবর্তীতে ব্রাহ্মণ সমাজ সমাজে নিজস্ব প্রতিপত্তি রক্ষা করতে ,স্বার্থ অক্ষুণ্ণ রাখতে   ব্রাহ্মণেতর জাতকে শূদ্র বলে অভিহিত করে এবং বেদপাঠে তাদের সব অধিকার  কেড়ে নেয় ।আর তখন ,নারীদেরকেও শূদ্রসম বলে আখ্যা দিয়ে দেওয়া হয়। তাঁদের ওঁ-কার উচ্চারণে,বেদপাঠে, শালগ্রাম শিলা পূজায় সমস্ত অধিকার কেড়ে নেওয়া হয়েছিল। এই প্রসঙ্গে স্বামী  বিবেকানন্দের মন্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, “এদেশে পুরুষ-মেয়েতে তফাৎ কেন যে করিয়াছে ,তা বোঝা কঠিন।বেদান্তশাস্ত্রে আছে,একই চিৎসত্তা সর্বভূতে বিরাজ করিতেছেন।কোন শাস্ত্রে এমন কথা আছে যে ,মেয়েরা জ্ঞান ভক্তির অধিকারিণী হইবে না? ভারতের অধঃপতনের কারণ, ভট্টাচার্য বামুনেরা ব্রাহ্মণেতর জাতকে যখন বেদপাঠের অনধিকারী বলিয়া নির্দেশ করিলে, সেই সময় মেয়েদেরও সকল অধিকার কেড়ে নিলে।”     


           বর্তমানে ব্রাহ্মণরাই শালগ্রাম শিলা পূজা করেন।ব্রাহ্মণের ঘরের পত্নীরা পর্যন্ত পূজার সব রকম ব্যবস্থা , জোগাড় করে দেবার পরও উপবাস করে শুষ্ক মুখে বসে থেকে অপেক্ষা করেন কখন তাঁদের পতিদেব বা অন্য পুরোহিত এসে পূজা সাঙ্গ করবেন । কিন্তু , বৈষ্ণবীয় ভক্তিসাধন পদ্ধতি গ্রন্থ 'শ্রীহরিভক্তি বিলাস'-এ  স্কন্দপুরাণের শ্লোকের উল্লেখ আছে ;যাতে বলা হয়েছে -- ভগবৎ ভক্তিপরায়ণ,সদাচারনিষ্ঠ ,যথাবিধানে দীক্ষাগ্রহণকারী ব্রাহ্মণ, স্ত্রী, শূদ্র সকলেই শ্রীশালগ্রাম বা শ্রীবিগ্রহরূপী ভগবানের  সেবাপূজা করবেন।

"এবং শ্রীভগবান্ সর্ব্বৈঃ শালগ্রাম-শিলাত্মকঃ।

দ্বিজৈঃ স্ত্রিভিশ্চ শূদ্রৈশ্চ পূজ্যো ভগবত- পরৈঃ।।" (স্কন্দ)


                        প্রসঙ্গত, গৌড়ীয় বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে শ্রীনিত্যানন্দ প্রভুর পত্নী শ্রীমতী জাহ্নবাদেবীই  প্রথম মহিলা দীক্ষাগুরু। সেটা ছিল ১৫৫৫ খ্রিষ্টাব্দ।তাঁর আগে কোন মহিলা দীক্ষাগুরু হননি।আবার সমগ্র রাঢ়বাংলা জুড়ে বিগ্রহ প্রতিষ্ঠার মহোৎসবে তিনিই নেতৃত্ব দিতেন সেসময়। তাঁর দীক্ষাদান প্রথাকে অনুগমন করেছিলেন শান্তিপুরে শ্রীঅদ্বৈত গৃহিনী সীতাদেবী এবং যাজিগ্রামের শ্রীনিবাস আচার্যের কন্যা হেমলতাদেবী।


  পন্ডিতপ্রবর শ্রীজ্যোতির্ময় নন্দ মহাশয় বর্তমান  নারীসমাজকে অনুপ্রেরণা দিয়েছেন এই বলে যে--"সকল কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা ও ভ্রষ্টাচারের কথা বর্জন করে ঈশ্বরভক্ত নিজের রুচিমত সদগুরুর নিকট ভগবান বা ভগবতীর মহানাম বা মহামন্ত্রের দীক্ষা লাভ করে জীবন ধন্য ,শান্তিপূর্ণ ও সার্থক করুন। নিজেরাই গৃহে দেবদেবীর ও শালগ্রাম শিলা প্রভৃতির পূজা,অন্ন,ভোগাদি নিজহস্তে করুন।যে যার গৃহে কর্তব্য কর্মসমূহের অনুষ্ঠানের সহিত ঈশ্বরের স্মরণ-মনন ও নামকীর্তনে যুক্ত থাকলে গৃহে থেকেই বৃন্দাবন,বারাণসী,তারাপীঠ প্রভৃতি তীর্থস্থানে বাস ও গঙ্গাস্নানাদির ফল পাবেন। এটাই আমাদের শাস্ত্র বাক্য ও সাধু মহাজনগণের সারকথা এবং তাঁদের  কৃপায় অতি নগণ্য আমার দৃঢ় অনুভব। গীতা ,ভাগবত ও চন্ডী প্রভৃতির অর্থবোধে নির্মল আনন্দ ও ভক্তি লাভের জন্য আপনারা প্রত্যেকে সংস্কৃত ভাষা শিক্ষা করুন। বাংলা অনুবাদ পড়লেও আনন্দ পাবেন।" 

                             ( জ্যোতির্ময় রচনাঞ্জলি)                 

                  মনু সংহিতায় বলা হয়েছে--"অর্থনৈতিক ব্যবস্থাপনায় , স্বাস্থ্যবিধি বব্যস্থাপনায়, আধ্যাত্মিক ও ধর্মীয় অনুষ্ঠান পালন,পুষ্টি এবং গৃহের সকল প্রকার ব্যবস্থাপনায়  নারীদের স্বায়ত্তশাসন ও কর্তৃত্ব প্রদান করতে হবে।"(মনু স্মৃতি: ৯.১১)-- এই শ্লোকের মধ্য দিয়ে এটাই প্রমাণ হয় যে ,  বৈদিক ধর্মকর্ম নারীরা করতে পারবে না এমন নির্দেশ কিন্তু মনু সংহিতা দেয় নি। অতএব, কেউ যদি বলেন নারীরা যজ্ঞের অনধিকারী তবে তিনি মনু এবং বেদবিরোধী মন্তব্য করলেন, বলা যায়। এই শ্লোকের দ্বারা বোঝানো হয়েছে পুরুষদের সাথে নারীদেরও অধিকার আছে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে। তাই নারীরা যজ্ঞে অংশগ্রহণ করতে পারবেন নিঃসঙ্কোচে। 


             সেই বৈদিক যুগে প্রচলিত ছিল যে প্রাচীন সনাতনী প্রথা ,যা  কালের করালগ্রাসে কিছু স্বার্থান্বেষী মানুষের সুচতুর কৌশলে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল ,লোকচক্ষুর অন্তরালে চলে গিয়েছিল, অপ্রচলিত হয়ে গিয়েছিল---- সেগুলিকে আবার ইদানিং সমাজে আধুনিক  নাগরিকদের চেতনায় ,মননে ও আচরণে ফিরিয়ে আনার প্রচেষ্টা শুরু করেছে বেশ কয়েকটি সংস্থা ও আশ্রম। 

( যেমন,কলকাতা সেবাপীঠ মাতৃমন্দির, কলকাতা, বাঁকুড়া শালতোড়ের সংস্থা ইত্যাদি) নারীরা প্রথাগত নিষেধাজ্ঞার অচলায়তন ভেঙে এ যুগে নতুন আশার আলো আনছেন সমাজে তাঁদের অধিকারের । কিন্তু, কিসের অধিকার?  যজ্ঞে এবং পৌরোহিত্য কর্মে নারীরা যে ব্রাত্য নন, অচ্ছুৎ নন, অনধিকারী নন সেই সত্য সংস্থাপনের অধিকার।


              নারীশক্তির জয় তখনই সম্ভব হবে যখন প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীদের অধিকারকে স্বীকৃতি ও সম্মান দেওয়া হবে। স্বামীজী বলেছিলেন, ‘নারীরাই পারে নারীদের উন্নতি সাধন করতে’। অতএব, আমাদের নারীদেরও উচিৎ উন্মুক্ত মনে এধরণের পদক্ষেপে এগিয়ে আসা। নারীদের 'মাতৃরূপেণ' হবার পথে এ এক উল্লেখযোগ্য পদক্ষেপ গ্রহণ হবে তখন ।


                               সমাপ্ত

Comments

  1. পুরোটা পড়লাম। কিন্তু পোস্টে স্ত্রীজাতি যজ্ঞে আহুতি দিত এটার উপযুক্ত প্রমাণ খুঁজে পেলাম না। যজ্ঞস্থলে বসা আর যজ্ঞে আহুতি দেওয়া এক বিষয় নয়। দ্বিতীয়ত এত বৈদিক বৈদিক করে লাফাচ্ছেন একটু মহানির্বান তন্ত্র ঘেটে দেখুন সেখানে কি বলা আছে। স্বয়ং সদাশিব নিজেই বলেছেন যে যেখানে গোহত্যা হয় শূদ্র বেদ শ্রবণ ক‍রে সেখানে বৈদিক কর্ম নিস্ফল। আপনি মুর্শিদাবাদ যান আর গার্ডেনরিচ যান একটু খোঁজ নিয়ে দেখুন গরু কেটে ঝুলিয়ে রেখেছে কিনা। আর তখনকার যেসব নারীদের উদাহরণ দিলেন তারা সকলেই পতিব্রতা নারী ছিলেন। রামায়ণ, মহাভারত এর উদাহরণ দিচ্ছেন তো? ওখানেই একটি ঘটনা তুলে ধরেছি তবে শুনুন– দেবরাজ ইন্দ্রের কেচ্ছা কাহিনীতো কম ছিলনা, তো এইরকমই এক কেচ্ছা কাহিনীর পর স্বর্গে তার কীর্তিকালাপ চাউর হওয়াতে কোনো এক পর্বতের নীচে এক জলাধারে পদ্মপত্রে সূক্ষাত্মিসূক্ষদেহে গা ঢাকা দিয়েছিলেন। ওদিকে স্বর্গের দেবতা মর্ত‍্যের ঋষিগণ নহুষকে স্বর্গের রাজা করে দেন। নহুষ ধার্মিক হলেও সুন্দরী ইন্দ্রানীকে দেখে লোভ সামলাতে পারেননি। ইন্দ্রানী নহুষের হাত থেকে বাঁচার জন্য নিজ পতি ইন্দ্রকেই খুঁজতে লাগলেন। তো এই হল পতিব্রতা নারী। আজকাল এইরকম নারী সহজে পাওয়া যাবে কি! ? যে নিজের স্বামী দুস্কর্মা জেনেও তার চরনসেবা করবে? অত্রিমুনী যখন ভিক্ষা করতে যেতেন তখন তার পদ প্রতিদিন ধুয়ে দিত তার পতিব্রতা স্ত্রী অনুসূয়া, আর আজকাল??? স্বামীকেই তুই তোকারি, ব‍্যাঙ্ক ব‍্যালেন্স দেখে ভালোবাসা, বিয়ে। এখনতো নারীবাদী হতে হতে পাত্রকে কেনাবেচা চলে। আগে এদের মতো যোগ‍্যতা অর্জন করতে শিখুন তারপর আপনার ঋগ্বেদ বেদ,সামবেদ দেখাবেন।

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

মাতৃরূপেণ—১২, 'অন্নপূর্ণে সদাপূর্ণে....'—শ্রীজীবশরণ দাস

কালীকথা-৩—পরমব্রহ্ম শবরূপ তাই — ড. অর্ঘ্য দীপ্ত কর

মাতৃরূপেণ—৫, বঙ্গ-মননে পরিবার-সমন্বিতা দুর্গা দর্শন—রাধাবিনোদ ঠাকুর