রবীন্দ্র-আলোকে ললিত ভারতী—সমীপেষু দাস

Image
  রবীন্দ্র-আলোকে ললিত ভারতী কাব্যসরস্বতী কোনো মন্দিরের বন্দিনী দেবতা নন                                                                                                       ( মধুমঞ্জরি, বনবাণী )                        রবীন্দ্রনাথ কাব্য ও সংগীতকে কখনওই পৃথক ব’লে ভাবতেন না। প্রথম জীবনের তাঁর কাব্যগুলির নামকরণ-ই তার যথাযথ প্রমাণ – সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল  ইত্যাদি। এমনকি যে কাব্যের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান; তা-ও গীতাঞ্জলি। তাঁর রচিত অসংখ্য কবিতা-ই গানের রূপ পেয়েছে। ব্যক্তিজীবনে তিনি তাঁর কাব্যরচনার প্রেয়সীরূপে পেয়েছিলেন তাঁর ‘নতুন বৌঠান’ তথা কাদম্বরী দেবী-কে। তিনি যখন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে আসেন; তখন বয়সে তিনি বালিকা। তাই সেই ছবিই পরবর্তীত...

মাতৃরূপেণ—২ আদ্যাশক্তি—কাজী নজরুল ইসলাম


আদ্যাশক্তি

 

 











          কাজী নজরুল ইসলাম  

মহাবিদ্যা আদ্যাশক্তি পরমেশ্বরী কালিকা।


পরমা প্রকৃতি জগদম্বিকা, ভবানী ত্রিলোকপালিকা।।


     মহাকালী মহাসরস্বতী


     মহালক্ষ্মী তুমি ভগবতী


তুমি বেদমাতা, তুমি গায়ত্রী, ষোড়শী কুমারী বালিকা।।


কোটি ব্রহ্মা, বিষ্ণু, রুদ্র, মা মহামায়া তব মায়ায়


সৃষ্টি করিয়া করিতেছ লয় সমুদ্রে জলবিম্বপ্রায়।


   অচিন্ত্য পরমাত্মারূপিণী


   সুর-নর-চরাচর-প্রসবিনী;


নমস্তে শিবে অশুভনাশিনী, তারা মঙ্গলসাধিকা।।



বিভিন্ন অবতারে জীবের কল্যাণের জন্য তাঁহারই অংশ-শক্তি আবির্ভূতা হন। তাঁহার সেই শক্তিকে প্রত্যক্ষ করেন দেবদেবী, যোগী, মুনিঋষি প্রভৃতি দিব্যজ্ঞানসম্পন্ন নর-নারী। অন্যে দেখিলেও তাহা বিশ্বাস করে না। কারণ তাহারা সম্পূর্ণরূপে দেখিতে পায় না, তাহাদের দৃষ্টি পরিচ্ছন্ন নয়। তাহাদের ওই দেখা ভুল দেখা। তিনি নিত্যা, তিনি উৎপন্না হন না ; যখনই ধর্মের গ্লানি, অধর্মের উৎপীড়ন চলে, তাঁহার সৃষ্ট জীব দানব শক্তির দ্বারা নিপীড়িত হয়, নির্জিত হয়, তখনই তাঁহার শক্তি অবতার রূপে প্রকাশিত হয়। এই পৃথিবীতে তখনই সেই পীড়নকারী অসুরশক্তির সংহার করিয়া তিনি জগতে ধর্মের প্রতিষ্ঠা করেন। যাহা সৎ, যাহা মঙ্গলময়, যাহা জীবের শুভদ, তাহারই সন্ধান দিয়া সেই অবতাররূপিণী শক্তিধ্রবজ্যোতিঃ অনন্ত শক্তিতে বিলীন হন। নারীরূপে পরমাত্মার যে অবতাররূপে প্রকাশ, আমরা আজ তাঁহারই বন্দনা গান গাহিব। তাঁহার প্রথম অবতার মহাকালীরূপে। সৃষ্টির প্রারম্ভে যখন পৃথিবী কারণ-সলিলে নিমগ্ন ছিল সেই সময় মধু-কৈটভ নামক দুই দৈত্য ব্রহ্মধ্যানরত ব্রহ্মাকে গ্রাস করিতে উদ্যত হইলে ব্রহ্মা বিষ্ণুর শরণাপন্ন হন, কিন্তু যোগ-নিদ্রভিভূত বিষ্ণুকে জাগাইতে না পারিয়া ব্রহ্মা যোগ-নিদ্রারূপিণী শক্তির স্তব করেন। যিনি যোগনিদ্র্য হইয়া বিষ্ণুকেও অচেতন করিয়া রাখেন, সেই সকল শক্তির শক্তি, ব্রহ্মার স্তবে সন্তুষ্ট হইয়া বিষ্ণুকে ত্যাগ করিয়া গেলে, বিষ্ণুও জাগ্রত হইয়া মধুকৈটভকে নিহত করেন। ইহাই হইল মধুকৈটভ-বধ উপাখ্যানের সারাংশ।




আমার স্বল্প-পরিসর জ্ঞানে, এই মধুকৈটভ-বধের যে অর্থ প্রতিভাত হইয়াছে তাহা বলিতেছি : মধুকৈটভ আর কেহ নয়, অধৈর্য ও অবিশ্বাস নামক দুই দৈত্য। বিষ্ণুর কর্ণমূল হইতে মধুকৈটভের উৎপত্তি। বিষ্ণু অর্থাৎ সাত্ত্বিকী শক্তিসম্পন্ন পুরুষ। তাঁহার কর্ণমূল অর্থে আমি মনে করি, দিবারাত্রি আমরা পণ্ডিতগণের নিকট যে বিচার-তর্ক ইত্যাদি শুনি – তাহাই। এই ব্রহ্মজ্ঞান-পণ্ডকারী পণ্ডিতদের কূটতর্ক বিচার প্রভৃতিই আমাদের বিশ্বাস স্থিত হইতে দেয় না। এই কর্ণমূল হইতেই অধৈর্য ও অবিশ্বাসরূপী মধুকৈটভের জন্ম। দেবী-ভাগবতে আছে, এই মধুকৈটভ আবার বাগ্‌বীজসিদ্ধ। কাজেই বাগ্‌বিতণ্ডাই যে মধুকৈটভের পিতামাতা, তাহাতে আর বিচিত্র কি?


অধৈর্য ও অবিশ্বাস, এই দুই ভাই, ব্রহ্মা অর্থাৎ জীবের ব্রহ্মজ্ঞানকে স্থির থাকিতে দেয় না। সর্বদাই তাকে তাড়না করে। তখনই রজোগুণ-সম্পন্ন অর্থাৎ তপস্যার অহংজ্ঞানযুক্ত ব্রহ্মা বিষ্ণুর অর্থাৎ সত্ত্বগুণের শরণাপন্ন হন ; কিন্তু সত্ত্বগুণসম্পন্ন হইলেও এই দুই দৈত্যের অর্থাৎ অধৈর্য ও অবিশ্বাসের হাত হইতে উদ্ধার পাওয়া যায় না। তখন পরমাত্মারূপিণী আদ্যাশক্তির শরণাপন্ন হইলে তাঁহার করুণায় বিষ্ণু বা সত্ত্বগুণ অধৈর্য ও অবিশ্বাসীরূপী দুই দৈত্যকে নিহত করেন। তখনই ব্রহ্মা বা ব্রহ্মজ্ঞানের স্থিতি হয়। এই জন্যই শ্রীশ্রীচণ্ডী পাঠের আগে ‘ব্রহ্মরন্ধ্রে মধুকৈটভ-বধ মাহাত্ম্যায় নমঃ’ বলিয়া মাহাত্ম্যন্যাস করিতে হয়। যোগনিদ্রারূপিণী মহাকালী ব্রহ্মরন্ধ্রে এই দুই দৈত্যকে নিহত করেন। দেবীর প্রথম অবতার মহাকালীরূপে। এইরূপে তিনি মধুকৈটভকে সম্মোহিত করেন এবং বিষ্ণু তাহাদিগকে নিহত করেন।

Comments

  1. অপূর্ব , অনবদ্য!!
    মধু-কৈটভ বিধ্বংসী বিধাত্রী বরদে নমঃ🙏🙏
    কাজী নজরুল ইসলামের রচনায় আদ্যাশক্তির মহিমান্বিত লীলা উপাখ্যান 🙏🙏💓🙏🙏
    জয় মা যোগমায়া
    জয় নিতাই

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

মাতৃরূপেণ—১২, 'অন্নপূর্ণে সদাপূর্ণে....'—শ্রীজীবশরণ দাস

কালীকথা-৩—পরমব্রহ্ম শবরূপ তাই — ড. অর্ঘ্য দীপ্ত কর

মাতৃরূপেণ—৫, বঙ্গ-মননে পরিবার-সমন্বিতা দুর্গা দর্শন—রাধাবিনোদ ঠাকুর