মাতৃরূপেণ—১৭, "সুবর্ণ গোলক"-এ প্রতিফলিত চিন্তার সেকাল এবং একাল—শাল্মলী রায়
- Get link
- X
- Other Apps
"সুবর্ণ গোলক"-এ প্রতিফলিত চিন্তার সেকাল এবং একাল
—শাল্মলী রায়
শিক্ষিকা, স্বাধীন গবেষক, সম্পাদক—স্টুডিয়ো 15।
সোশ্যাল মিডিয়া খুললেই শেষ দুদিনের সবচেয়ে চর্চিত বিষয় বলে মনে করতে গেলেই মনে পড়বে একটি বিশেষ অলঙ্কার প্রস্তুতকারী সংস্থার একটি বিশেষ বিজ্ঞাপনের কথা, যেখানে দুটি ভিন্ন সম্প্রদায়ের পরিবারের এবং সংস্কৃতির মিলন দেখানো হয়েছে। বিজ্ঞাপনটি যথেষ্ট প্রশংসা পেলেও কোথাও তা বিশেষ আঘাত করেছে কিছু বিভাজ্যবাদীকে যারা আসলে মিলনের বদলে বিভাজন এবং একতার বদলে একক হওয়াকেই বেশি গুরুত্ব দেয়। ঠিক এখানেই একটি প্রশ্ন উঠে এসেছে যেটা বর্তমান সামাজিক পরিস্থিতিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন। প্রশ্নটি যোগ্যতার এবং অবশ্যই যোগ্যতা নির্ণয়ের মাপকাঠিকে ঘিরে। একটা মানুষের অধিকার, তার ব্যক্তিস্বাধীনতার পরিধি ঠিক কতখানি হলে তা অপর কাউকে আঘাত করে না সেটা যেমন এক্ষেত্রে ভাবতে হয়, ঠিক তেমনি ভাবতে হয়, কোন পরিস্থিতিতে ক্ষমতা আর তার অপব্যবহারের মধ্যে থাকা সূক্ষ্ম ব্যবধানটি ঘুচে পরিস্থিতি অসহনীয় করে তোলে। আর এই পরিস্থিতি অসহনীয় হতে হতেই একটি সময় আসে যখন প্রতিবাদ করাটা আবশ্যক হয়ে দাঁড়ায়। অথচ ঠিক কোন পদ্ধতিতে প্রতিবাদ হবে তা নিয়ে সন্দিহান থাকেন অনেকেই। কিন্তু শিল্পী বা সাহিত্যিকের প্রতিবাদ সবসময়ই অভিনব এবং বর্তমান মিডিয়ার দৌলতে তা দিনে দিনে সূক্ষ্ম রসের প্রতিফলনেই লালিত। কিন্তু যদি বেশ কিছু সময় পিছিয়ে যাওয়া যায় তাহলে দেখা যাবে যে এই ধরণের প্রতিবাদের সূত্রপাত কিন্তু আজ হয়নি।
শিল্প বা সাহিত্যে প্রতিবাদ নতুন নয়, তবে প্রতিবাদ শিল্প বা সাহিত্যের ধারা খুব বেশি পাদপ্রদীপের আলোয় আসে বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী পরিস্থিতিতে। কিন্তু তার আগে কি তবে প্রতিবাদ হত না? ঔপনিবেশিক ব্যবস্থায় বিভিন্ন ইউরোপীয় শক্তির আগ্রাসনে কি তবে মানুষ বা আরো বেশি করে বলতে গেলে শিল্প বা সাহিত্যের সঙ্গে যুক্ত মানুষেরা প্রতিবাদ করেননি? উত্তর টা কিন্ত ইতিবাচক। তারা প্রতিবাদ করেছেন এবং শিল্প বা সাহিত্যমূল্যের বিন্দুমাত্র ত্রুটি না ঘটিয়ে সেই প্রতিবাদ এমনভাবেই করেছেন যা পরবর্তিকালে এমনকি আজকের এই ক্ষমতার আস্ফালন ও তার অপব্যবহারের যুগেও সমান প্রাসঙ্গিক। এই প্রাসঙ্গিকতা, যোগ্যতা, ক্ষমতার অপব্যবহার ইত্যাদির বিষয়ে বলতে গিয়ে একটি বিশেষ প্রবন্ধের কথা এই মুহূর্তে মনে পড়ছে। যখন পুজো আসছে, যখন আকাশ বাতাসে বেজে চলেছে আগমনীর সুর ঠিক সেই সময়ে বাংলা সাহিত্যের এই বিশেষ লেখাটি যেন যুগের প্রতিবিম্ব হয়ে উঠেছে।
সাহিত্যিক বঙ্কিমচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় বাংলা সাহিত্যের উজ্জ্বলতম নক্ষত্রদের অন্যতম এবং তার যাবতীয় প্রবন্ধে যে বিষয়টি চিরকাল উঠে এসেছে তা হল সামাজিক নানা ত্রুটি বিচ্যুতির বিরুদ্ধে তীক্ষ্ণ শ্লেষ এবং সরস প্রতিবাদ। অথচ কোথায় যেন অবহেলার এক পর্দায় আচ্ছাদিত হয়ে আছে এই প্রাসঙ্গিক রচনাগুলো। আজ চেষ্টা করব তারই একটির ধুলো সামান্য হলেও ঝেড়ে মুছে তাকে আলোয় আনতে। বঙ্কিমচন্দ্র তার ব্যক্তিগত জীবনে যেমন কোনো আস্ফালনকেই বিশেষ আমল দেননি, অবিচল থেকেছেন তার নিজস্ব ঋজুতায় তেমনি প্রবন্ধে যখন প্রতিবাদ করেছেন তখন তারও ভাষা বা ভাবের মধ্যে সেই কঠোরতাকেই এব বজায় রেখেছেন। অথচ তার মধ্যেই সচেষ্ট হয়েছেন আঙ্গিকের অভিনবত্ব আনার বিষয়ে। এই আঙ্গিকের অভিনবত্ব নিয়ে ভাবতে গেলেই যে প্রবন্ধগুলির কথা বলতেই হয় তা সংকলিত হয়েছে তার "লোকরহস্য" তে। রহস্য মানেই যে কেবল কৌতুক নয় বরং তার মধ্যে এক গভীর সামাজিক এবং জীবনবোধের প্রতিফলন ঘটে, এই কথাটাই যেন এই বইয়ের পরতে পরতে প্রকাশ পেয়েছে। পুরাণ, ইতিহাস, লোককাহিনী সবকিছুর সঙ্গে মিলেমিশে গেছে ঔপনিবেশিকতা পরবর্তী সাহিত্যিক মূল্যবোধ। এরই সঙ্গে যে বিশেষ আঙ্গিকটি বা যে বিশেষ সাহিত্যিক প্রকরণকে খুঁজে পাওয়া যায় তা হল Absurdity। Absurd literature এর জন্ম হিসেবে যদিও উল্লেখ করা হয় দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ পরবর্তী প্রতিবাদের সময়কে, এবং তার সূত্রপাত নাটকের হাত ধরে হয়েছে এই মত গ্রাহ্য হলেও তার পূর্ববর্তী বেশ কিছু সাহিত্যে কিন্তু এর ছায়া বেশ গভীরভাবেই পাওয়া যায়। এবং এক্ষেত্রে একটি গভীর খেদের বিষয় এটাই যে পিরানদেল্লো বা স্যামুয়েল বেকেট এই absurd সাহিত্যের পাদপ্রদীপের আলোয় যেভাবে আসেন, বঙ্কিমচন্দ্রের এই বিশেষ ধরণের প্রবন্ধের মধ্যে সেই ধারার সন্ধান প্রায় কেউই করে দেখেননি। একে কেবল সরস, কৌতুকময় , শ্লেষাত্মক আখ্যা দেওয়া হয়ে বিশ্ব সাহিত্যের নিরিখে নেহাতই ক্ষুদ্র মাপকাঠিতে মাপা হয়ে এসেছে।এই ধারারই একটি প্রবন্ধ এই 'লোকরহস্য' গ্রন্থটির "সুবর্ণ গোলক' প্রবন্ধটি। এই প্রবন্ধে শিব পার্বতীর প্রচলিত কাহিনীর সঙ্গে প্রতিভাত হয়েছে গভীর সামাজিক ত্রুটি বিচ্যুতিসমূহ, যেই ত্রুটি বিচ্যুতিগুলি সমাজের নানান স্তরে কেবল সমস্যাই আনে না, গভীরভাবে মানবিক মূল্যবোধ এবং আত্মমর্যাদাকেও প্রতিনিয়ত আঘাত করে চলে। অথচ প্রায় প্রত্যেকেই তা সহ্য করে, দেখেও না দেখার ভান করে এবং ধীরে ধীরে ক্ষমতার অপব্যবহারের কাছে নতি স্বীকার করে। প্রতিবাদের চেষ্টাটুকুও যারা করে তাদের কণ্ঠরোধ করা হয়।
এই প্রবন্ধ যেই সময়ে রচিত সেই সময়ে ভারতে ব্রিটিশ শাসন চলছে এবং নানাবিধ সংস্কার ও নিয়মকানুনের পরিবর্তনের ফলে ক্রমাগত পরিবর্তিত হয়ে চলেছে মূল্যবোধ। বিদেশী শাসনের অন্যায়ের প্রতিবাদ না করে চলছে তোষামোদের রাজত্ব। যাদের রাজা হবার কথা তারা প্রজা হয়ে বিদেশী শাসকের পদলেহন করে চলেছে নিয়মিত। তাই শিবের বক্তব্য হিসেবে লেখক লিখেছেন,
" এ সকল পৃথিবীতে নিত্য ঘটে, কিন্তু তাহা যে কি প্রকার হাস্যজনক, তাহা কেহ দেখিয়াও দেখে না। আমি তাহা একবার সকলের প্রতক্ষীভূত করাইলাম। এক্ষণে গোলক সম্বৃত করিলাম।"
এই বক্তব্যতেই প্রকাশিত হয় লেখকের উদ্দেশ্য। তিনি যে সমাজের, রাষ্ট্রক্ষমতার ত্রুটিগুলোকে চোখে আঙুল দিয়ে দেখাতে চাইছেন তা চরিত্রের সংলাপের মাধ্যমে স্পষ্ট করে তুলে ধরেছেন। কেউ প্রতিবাদ না করলেও একজন প্রকৃত সাহিত্যিককে প্রতিবাদ করতেই হয়।
তাই আজ যখন দুর্গাপুজোর আগে , উমার বাপের বাড়ি আগমনের ঠিক আগে জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে মা এবং মেয়ের চিরকালীন সম্পর্ক নিয়ে তৈরী হওয়া একটি বিজ্ঞাপনকে রাষ্ট্রশক্তি তার ক্ষমতার আস্ফালন দেখিয়ে বন্ধ করতে নানাভাবে নিজেদের ক্ষমতাকে ব্যবহার করে এবং তার প্রতিবাদ খুব মৃদুভাবে হয় তখন কোথাও বঙ্কিমচন্দ্রের দৃঢ় লেখনীর কথাই মনে আসে, মনে আসে শিবের মতই চোখে আঙুল দিয়ে সত্যিটা দেখাতে চাইবার এক মানুষের কথা।
- Get link
- X
- Other Apps
Comments
Post a Comment