রবীন্দ্র-আলোকে ললিত ভারতী—সমীপেষু দাস

Image
  রবীন্দ্র-আলোকে ললিত ভারতী কাব্যসরস্বতী কোনো মন্দিরের বন্দিনী দেবতা নন                                                                                                       ( মধুমঞ্জরি, বনবাণী )                        রবীন্দ্রনাথ কাব্য ও সংগীতকে কখনওই পৃথক ব’লে ভাবতেন না। প্রথম জীবনের তাঁর কাব্যগুলির নামকরণ-ই তার যথাযথ প্রমাণ – সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল  ইত্যাদি। এমনকি যে কাব্যের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান; তা-ও গীতাঞ্জলি। তাঁর রচিত অসংখ্য কবিতা-ই গানের রূপ পেয়েছে। ব্যক্তিজীবনে তিনি তাঁর কাব্যরচনার প্রেয়সীরূপে পেয়েছিলেন তাঁর ‘নতুন বৌঠান’ তথা কাদম্বরী দেবী-কে। তিনি যখন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে আসেন; তখন বয়সে তিনি বালিকা। তাই সেই ছবিই পরবর্তীত...

মাতৃরূপেণ—১৮, বিসর্জনে বিজয়া—সমীপেষু দাস

 বিসর্জনে বিজয়া


বাংলার উৎসবের গান এক বিশেষ জায়গা নিয়ে রয়েছে। বাঙালির জাতীয় উৎসব দুর্গাপুজোকে ঘিরেও এক ধরণের গান প্রচলিত রয়েছে। এই চারদিনের দুর্গাপুজোর প্রতিদিনেরই মেজাজ একেক রকম। একেবারে মহালয়ার দিন ভোরে দেবীর চোখ আঁকার সাথে সাথেই ‘পুজো পুজো গন্ধ’ ছড়িয়ে পড়া আর প্রতিদিনের ব্যস্ততা থেকে একটু ছুটি খোঁজা, ষষ্ঠীতে বোধনের সময় মাঙ্গলিক আচার, সপ্তমীতে নবপত্রিকার স্নানে একজোট হয়ে দোলা নিয়ে নদীতে বা স্থানীয় জলাশয়ে যাওয়া, অষ্টমীতে দেবীর চরণে পুষ্পাঞ্জলি দেওয়ার সময় মাঞ্জা দিয়ে ধুতি-পাঞ্জাবি পরা বা বাহারি পঞ্চব্যঞ্জন পদ সাজিয়ে লুচি খাওয়া, সন্ধিপুজোয় আবার প্রদীপের আলোয় উজ্জ্বল হয়ে ওঠা,নবমীতে প্রসাদ পাওয়া এবং অবশেষে দশমীতে ঘটবিজয়া ও মূর্তিবিসর্জনে বিষাদের পরিবেশ।
 


তবুও আনন্দপ্রিয় বাঙালি এই দিনেও বিভিন্ন আচার-অনুষ্ঠানের পালনের মধ্যে দিয়েই আশায় বুক বাঁধে। এই আসা-যাওয়াকে কেন্দ্র ক’রেই বেশ কিছু গান রয়েছে। মূলতঃ রামপ্রসাদ সেনের আগমনী গান বেশি জনপ্রিয় হলেও বেশ কিছু বিজয়া পর্যায়ের গানও রয়েছে এবং পরবর্তী সময়ে সাধক কমলাকান্ত ভট্টাচার্য, পাঁচালিকার দাশরথি রায়, কবি মধুসূদন সকলেই বিজয়ার গান লিখেছেন। বাংলার সমাজে ঘরের মেয়ে উমা তিনদিনের জন্য বাপের বাড়িতে এসে নবমীর শেষে আবার শ্মশানচারী জামাই বুড়োশিবের সঙ্গে ফিরে যায় এবং মা মেনকার দুঃখের সীমা থাকেনা। এই ভাবই আজও বাঙালি মনে-প্রাণে বিশ্বাস করে। সাধারণতঃ দশমীতে বাড়ির বা বারোয়ারি পুজোমণ্ডপে বরণের পরে সিঁদুরখেলার শেষে প্রতিমার বিসর্জন হয়ে যায়। একদিকে সেই সময়ে যেমন সকলের চোখ ভিজে যায়, আবার তেমনই তারপরেই বাঙালির ঘরে ঘরে প্রণাম, মিষ্টিমুখ, শুভেচ্ছা-বিনিময় চলতে থাকে। কিন্তু  এই রীতি-রেওয়াজের কি প্রয়োজন ? প্রতিমার জলে বিসর্জনের সঙ্গে ‘শুভ বিজয়া’-র সম্পর্ক কোথায় ? ব্যাপারটিকে একটু বিচার করতে হয়।  উমার বাপের বাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ার বিরহের মূহুর্তের বিষয়কে ঘিরেই যাবতীয় গানগুলি লেখা ও গাওয়া হতো  ১৮-১৯ শতকে। কলিকাতার বনেদি বাড়ির পুজোর সময় বিখ্যাত কবিয়ালরাও কবিগানের একটা পর্যায়ে শাক্ত দেবদেবীদের কথামূলক গান গাইতেন। কিন্তু বাংলার প্রতিটি উৎসব ও লোকসংগীতের মধ্যেই নীতিশিক্ষা বা দর্শনের ভূমিকা থাকে। যে কোনও শাস্ত্রীয় বিধি-বিধানের একটি প্রধান দায় থাকে শিক্ষাদানের। ‘বিজয়া’ শব্দের অর্থ জয়লাভ করা। পুরাণোক্ত দেবী দুর্গার অশুভ শক্তিকে দমন ক’রে জয়ের কথা না হয় মানলাম ; কিন্তু উমার বাপের বাড়ি ছেড়ে শিবের সঙ্গে ফিরে যাওয়ার মধ্যে জয়ের ইঙ্গিত কই ! আমরা যদি ভারতীয় দর্শনের দিকে বা বলা ভালো যে বিশেষ ক’রে বেদান্ত দর্শনের দিকে খেয়াল করি, তাহলে দেখি আমরা সাংসারিক মানুষেরা প্রত্যেকেই মায়ায় আবদ্ধ হয়ে আছি। তাই কারোর মৃত্যু দেখলে আমরা কেঁদে উঠি, কেও চলে গেলে আমরা বিরহে কাতর হই। কিন্তু যদি এই জাগতিক বন্ধনকে কাটিয়ে উঠতে পারি, তাহলে মুক্তি ঘটে। শোক-দুঃখ-মোহকে অতিক্রম করে গেলেই আনন্দের সন্ধান পাই। কিন্তু এ’ত বড়ো দার্শনিক কথা তো সাধারণ মানুষের পক্ষে বোঝা সম্ভব নয়। তাই সবার জন্যই যেমন সার্বজনীন দুর্গোৎসব চালু হয়েছিল, তেমনই সেকালের সমাজব্যবস্থার একটি উদাহরণকে নিয়েই সহজভাবে দর্শনকে তুলে ধরা হলো। প্রত্যেক মা তার সন্তানকে গর্ভে ধারণ করে। তাই সন্তানের সঙ্গে তার নাড়ীর টান। বল্লাল সেনের কৌলীন্য প্রথায় সেকালে মেয়েদের বলি হতে হয়েছে। সমাজে মাথা উঁচু করে বাঁচার জন্যই বালিকা অবস্থাতেই মেয়েদের যেন তেন প্রকারে বিয়ে দেওয়া হতো। তাই মায়ের দুঃখ রয়েই যেতো। তাই উমাকে আদর্শ ধ’রে মায়ের বিচ্ছেদব্যথা-ই বারবার বিজয়ার গান এসেছে। আগমনী গানে যেখানে মায়ার প্রভাবে আবদ্ধ হয়েছে মেনকা, তেমনই বিজয়ার গানে মায়ার মায়াকে কাটিয়ে উঠেছে উমা। তবেই তো সে মহাকালের সঙ্গে মিলিয়ে গেছে। বাল্মীকির রামায়ণে রাম রাবণের সঙ্গে যুদ্ধের আগেই ‘আদিত্যহৃদয়স্তব’-এর আবৃত্তি  করে। ক্ষত্রিয়জাতির পরম ধর্ম-ই হ’ল শত্রুবিজয়। মানবজন্মেও বিভিন্ন ক্ষেত্রে  শত্রু বা রিপু আমাদের অন্ধকারের পথে নিয়ে যায়। তাই প্রবাদে দাঁড়িয়েছে “অতি দর্পে হতা লঙ্কা”। উদগ্র কামনা, বাসনা সবসময়েই নেশা হয়ে দাঁড়ায়। প্রথমে একতলা বাড়ি, তারপর দোতলা, তারপর বিলাসবহুল আবাসন, আরামদায়ক গাড়ি এই উত্তরোত্তর এই চাওয়া-পাওয়ার দাস হয়ে দাঁড়াই আমরা। তাই আমার মতের বিরুদ্ধে যারা কথা বলে বা যে আমাদের উন্নতির পথে বাধা হয়ে দাঁড়ায়; সে যেমন শত্রু বা প্রতিযোগী; তেমনই আমাদের মানসিকতাও কিন্তু প্রতি মূহুর্তে আমাদেরই ক্ষতি করে চলে। এমনকি রাগের বশে কারোর গায়ে হাত তোলা থেকে এমনকি নৃশংস হত্যাকাণ্ড সবই আমাদের ক্ষতি করে চলে। তাই দেবতার কাছে প্রার্থনা হওয়া উচিত এই সীমাবদ্ধতার থেকে যেন আমাদের মুক্তি ঘটে। নিজের শুভ চেতনা-ই একমাত্র সম্বল ; তাই বুদ্ধিরূপে সংস্থিতা দেবীর কল্যাণে সেই বুদ্ধি যেন চঞ্চল মনে স্থিরতা আনে। তাই রামচন্দ্রের রাবণবধের ঘটনা কিন্তু শুধুমাত্র রাবণের অপরিসীম অনৈতিকতার পরাজয়। যার যেখানে অধিকার নেই, যার যে বিষয়ে যোগ্যতা নেই; ভাগ্যচক্রে পেয়ে যাওয়া সেই সম্পত্তির বিনাশ ঘটবেই একদিন। তাই ক্ষত্রিয় জাতির যেমন ধর্ম-ই দেশের ও মানুষের রক্ষা। সে তার সর্বশক্তি দিয়ে বহিরাগত শত্রুদের হাত থেকে সকলকে রক্ষা করে। দেবী দুর্গা-ও অসুরকে বধ করে দেবকুলকে বা বৃহদর্থে সত্যকে রক্ষা করেছিলেন। তাই বাংলায় কন্যাভাবে দেবী পূজিত হলেও তার রূপেই আছে আসুরী প্রবৃত্তির বিনাশ।



 তাই এখনও কলকাতার শোভাবাজার-রাজবাড়ি সহ আরও অনেক বাড়িতে দশমীতে অস্ত্রপুজো করা হয়। তাই ভক্তের উদ্দেশ্য বা মন্ত্র – “জযং  দেহি”। তাই যেহেতু লাল রং শৌর্য, বীর্যের চিহ্ন; তাই সিঁদুরখেলা বা কপালে টিকা লাগানোর নিয়ম চলে আসছে। এটিও বিজয়ের প্রতীক। বরণ তো তখনই হয় যখন কাউকে শুভেচ্ছা জানানো হয়। বাংলা ও বাঙালির মনের বিশ্বাস যে উমা দশমীর দিনে কৈলাসে ফিরে যাবে। আমরা যদি বিয়ে বা দ্বিরাগমনের দিকে দেখি, সেখানে মেয়ে শ্বশুরবাড়িতে যাওয়ার আগে আশীর্বাদের স্ত্রী-আচার থাকে। বরণ করা হয় নতুন বউ বাড়িতে এলে। তাই বিজয়া দশমীর দিনে সধবা এয়ো স্ত্রী-রা মিলে সাদা-লালপাড়ে সাবেকি সাজে ‘মা’-কে বরণ করে নেয়। আসলে এটি ওই আসুরী শক্তিকে জয় করার জন্য স্বাগত জানানো এবং সাথে মিষ্টিমুখ করানো। যেহেতু মাটির মূর্তি গড়া হয়, তাই নিয়ম মেনে তাকে বিসর্জন করতেই হবে। দশমীবিহিত পুজোর পরে তারপরে অপরাজিতা পুজো করা হয়। অর্থাৎ অশুভ শক্তিকে বা মায়াকে বিসর্জন দিয়ে বিজয়ী হওয়া। তাই আগে আগে বিসর্জন এবং তারপরে বিজয়া। তাই এই বিসর্জনের সাথে বিজয়ার সরাসরি কোনও যোগ নেই; বরং বিসর্জনকে ষড়রিপু - কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ, মাৎসর্যের বলি দিয়ে জ্ঞানের পথে সত্যস্বরূপের দিকে এগিয়ে চলার অর্থে গ্রহণ করতে হবে। তাই ‘শুভ বিজয়া’।



লেখক— 

—সমীপেষু দাস

অধ্যাপক, বঙ্গবাসী ইভিনিং কলেজ

Comments

Popular posts from this blog

মাতৃরূপেণ—১২, 'অন্নপূর্ণে সদাপূর্ণে....'—শ্রীজীবশরণ দাস

কালীকথা-৩—পরমব্রহ্ম শবরূপ তাই — ড. অর্ঘ্য দীপ্ত কর

মাতৃরূপেণ—৫, বঙ্গ-মননে পরিবার-সমন্বিতা দুর্গা দর্শন—রাধাবিনোদ ঠাকুর