মাতৃরূপেণ—১৫, সাহিত্যে শাক্ত পদাবলীর বিশেষত্ব—অধ্যাপক সুমন ভট্টাচার্য্য
- Get link
- X
- Other Apps
সাহিত্যে শাক্ত পদাবলীর বিশেষত্ব
অধ্যাপক—বিশ্বভারতী
আমাদের বাংলা অত্যন্ত গর্ববোধ করে তার একটা রত্নখনির জন্য। যদিও বাংলায় হীরের খনি নেই, চুনি-পান্নার খনি নেই, তবে কয়লার খনি আছে। রাণীগঞ্জ-আসানসোল এলাকায় গেলে মাটি খুঁড়লেই কয়লা পাওয়া যায়। কিন্তু এমন দেশও পৃথিবীতে আছে, যেখানে মাটি খুঁড়লে হীরে পাওয়া যায়। আমাদের বাংলায় সেই হিসেবে হীরের খনি নেই, তবে বড় বড় পণ্ডিত, জ্ঞানীগুণীগণ বলে গেছেন, হীরের থেকেও মূল্যবান রত্নের খনি আমাদের বাংলায় আছে। তার নাম পদাবলী সাহিত্য। এই পদাবলীর একটি সংকলন রবীন্দ্রনাথ নিজের দায়িত্বে তাঁর বন্ধু শ্রীশচন্দ্রের সঙ্গে প্রকাশ করেছিলেন। সেই পদের গ্রন্থটার তিনি নাম রেখেছিলেন—"পদরত্নাবলী"। পদাবলী সংগ্রহ নাম না রেখে রাখলেন "পদরত্নাবলী"।
এক একটা পদকে তিনি রত্নের মতো মূল্যবান মনে করেছেন। তাই সেই পদরত্নাবলী আমাদের বাংলায় মূলতঃ তিন ভাগে বিভক্ত, কিন্তু একটি ভাগ এখন মানুষের চর্চার মধ্যে আর মোটেই নেই। সেটা হল "চর্যাপদ"। এটি যদিও প্রাচীনতম বাংলার নিদর্শন কিন্তু মানুষের চর্চার মধ্যে সেই পদাবলী আর নেই। কোথাও গাওয়া হলে সেটা গায়ের জোরে হয়তো গাওয়া হয়। কিন্তু বাকি যে দু'ধরণের পদাবলী—বৈষ্ণব পদাবলী এবং শাক্ত পদাবলী, এগুলো কিন্তু এখনো আমাদের সাধারণ বাঙালিদের ধর্মচর্চা বা সংস্কৃতিচর্চার অন্তর্ভুক্ত। সেইজন্য বৈষ্ণব পদাবলীর কীর্তন গান সারা বাংলাতে হচ্ছে, বাংলার বাইরেও হচ্ছে। এই বৈষ্ণব পদাবলী বিরাট এক সাহিত্য। এখানে প্রায় বারো হাজার পদাবলী গানের মধ্যে আছে। আমরা নাড়াচাড়া করি সাধারণতঃ হাজার খানেক পদ। বেশিরভাগই গাওয়া হয় না। তবুও একটি বিষয়ে বৈষ্ণব পদাবলী বেশি আলোকপাত করে নি। আর সেই জায়গাটাতেই আলোকপাত বেশি করে করেছে শাক্ত পদাবলী।
শাক্ত পদাবলী এমন একটা বিশেষ রস সৃষ্টি করেছে যেটা বৈষ্ণব পদাবলীও করে নি। পারে নি বলব না, কারণ এত বড় বড় মহাজন ছিলেন পদকর্তা, তাঁরা ইচ্ছা করলেই পারতেন কিন্তু করেন নি। সেটা হল—ঈশ্বরকে কন্যারূপে চিন্তা করে তার প্রতি স্নেহপ্রকাশ। ঈশ্বরকে পুত্ররূপে চিন্তা করে তার প্রতি স্নেহপ্রকাশের পদ আমরা কৃষ্ণের বাল্যলীলায় পাই। যেখানে কৃষ্ণ কোলের ছেলে, কোনো উপাস্য দেবতা নয়, ফুল-তুলসী দিয়ে পুজো করার মতো কোন বিগ্রহ নয়। সে মা যশোদা-নন্দরাজার কোলের ছেলে। সেখানে ঈশ্বরকে পুত্ররূপে ভালোবেসে হাসির পদও যেমন আছে, তেমন কান্নার পদও আছে। কিন্তু ঈশ্বরকে কন্যারূপে চিন্তা করে গান গাওয়া—এটা কিন্তু বৈষ্ণব পদাবলী খুব বেশি করে নি। রাধারাণী বিষয়ক দু-একটা পদ পাওয়া যায় তার বাল্যলীলার, কিন্তু খুব একটা রসপুষ্ট সেগুলো বলা যায় না। শাক্ত পদাবলীর মধ্যে আগমনী গান—যেখানে মা দুর্গাকে তথা জগদীশ্বরীকে নিজের কন্যারূপে চিন্তা করে তার প্রতি স্নেহপ্রকাশ, তার জন্য হৃদয় যে কতখানি ব্যথিত সেই পদাবলীর মধ্য দিয়ে আমরা জানতে পারি। কাজেই আমার মতে, এই আগমনীর অংশ বিশেষ করে বৈষ্ণব পদাবলীর পরিপূরক। যে জায়গাটা বৈষ্ণব পদাবলী ধরে নি, সেই জায়গাটা শাক্ত পদাবলী বিশেষভাবে প্রকাশিত করেছে আগমনীর গানে। যেখানে মা দুর্গা উপাস্য দেবতা সাধারণ লোকের কাছে, কিন্তু মেনকার কাছে নয়। মা মেনকা—গিরিরাজ হিমালয়ের যিনি স্ত্রী,তার কাছে দুর্গা হল ঘরের মেয়ে। সেই ঘরের মেয়ের ঘরে ফেরাকে কেন্দ্র করেই এই সুমধুর পদাবলী সাহিত্য।
দাশরথি রায়ের একটি মূল্যবান পদে শাক্ত পদাবলী সাহিত্যের এই মূল ভাবটি প্রস্ফুটিত হবে। মা দুর্গা বছর পরে গিরিরাণী মেনকার ঘরে এসেছেন। মায়ের কোলে বসেছে তার ছোট ছেলে গণেশ। মেয়ে এবং নাতি উভয়ের প্রতি বাৎসল্যই এই পদে ফুটিয়ে তুলেছেন পদকার। পদটি নীচে লিখিত হল—
"বসিলেন মা হেমবরণী, হেরম্বে ল’য়ে কোলে।
হেরি গণেশ-জননী-রূপ, রাণী ভাসেন নয়ন-জলে।
ব্রহ্মাদি বালক যার, গিরি-বালিকা সেই তারা।
পদতলে বালক ভানু, বালক চন্দ্রধরা।
বালক ভানু জিনি তনু, বালক কোলে দোলে।।
রাণী মনে ভাবেন- উমারে দেখি, কি উমার কুমারে দেখি,
কোন্ রূপে সঁপিয়ে রাখি নয়নযুগলে।
দাশরথি কহিছে, রাণী, দুই তুল্য দরশন
হের, ব্রহ্মময়ী আর ঐ ব্রহ্ম-রূপ গজানন,
ব্রহ্ম-কোলে ব্রহ্ম-ছেলে বসেছে মা বলে।।"
রাণীর ঘরের মেয়ে রূপে উমার এই বিশেষত্ব শাক্ত পদাবলীর আগমনী গানকে তার নিজস্ব আসনে চিরকাল স্থান দিয়ে রেখেছে ও রাখবে। এ আমাদের মধুর সংস্কৃতির সাথে মিলেমিশে একাকার।
(দুর্গা ও গণেশের ছবি—শ্রী যামিনী রায়।)
- Get link
- X
- Other Apps
Comments
খুব সুন্দর লেখা,প্রণাম গুরুজী
ReplyDeleteDarun lekha abong bhavprokash,nirontor khoj ba proyas na thakle ato gobhir BHAKKHYA somehow na
ReplyDeleteঅসাধারণ লেখনী জয় নিতাই প্রভূ🙏🙏🙏
ReplyDelete