কালীকথা-১—বিদ্যাসুন্দর কাব্যে কালী : এক অনন্য ভূমিকায়—উৎসব চৌধুরী
- Get link
- X
- Other Apps
বিদ্যাসুন্দর কাব্যে কালী : এক অনন্য ভূমিকায়
—উৎসব চৌধুরী
গবেষক, যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়
অন্নদামঙ্গলের কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র। নিজের কবিসত্তার প্রতি তাঁর প্রত্যয় গভীর, তাই তিনি অনায়াসে বলতে পারেন “ভারত ভারত-খ্যাত আপনার গুণে”। আজ ভারতচন্দ্রের কাব্য নিয়ে একটু কথাবার্তা হোক।
ভারতচন্দ্রের কাব্যের দ্বিতীয় খণ্ড বিদ্যাসুন্দর ওরফে কালিকামঙ্গল। উচ্ছ্বসিত আদিরসের কারণে এ খণ্ড বিপুলভাবে লোকপ্রিয়।
দেবীর পারম্যবিবৃতি এই কাব্যখণ্ডের লক্ষ্য নয়, তা পূর্বখণ্ডেই প্রতিষ্ঠিত। মঙ্গলদেবীরূপে দেবীর পূজাপ্রতিষ্ঠাও এখানে লক্ষ্য নয়, দেবী ইতোমধ্যেই বঙ্গীয় জনসমাজে সুপূজিত। দেবীর ভূমিকা এখানেই নিতান্তই ব্যতিক্রমী,এখানে কালী নায়ক-নায়িকার ইষ্টদেবী, তাঁদের মিলনের সহায়ক।
ভারতচন্দ্র বহুবার নিজের কবিকৃতিকে ‘নূতন মঙ্গল’ বলেছেন। প্রচলিত মঙ্গলকাব্যধারার ছাঁচ অনুসরণ করলেও রচনার বহু স্থানে তাঁর ভাবনার নূতনত্ব, তাঁর স্বাতন্ত্র্য ও স্বকীয়তা প্রকট।
আজ, বিদ্যাসুন্দর নিয়ে কয়েকটা কথা বলা যাক। পূর্ণাঙ্গ আলোচনা নয়, টুকরো টুকরো ছবি।
. * *
কাব্যের প্রথম খণ্ডে প্রচলিত হর-পার্বতী কাহিনীকে কবি নানাভাবে ভেঙেচুরে নতুন করে গড়েছেন। একটা বড়ো বদল হল এই – মদনভস্মের পরেও নিহত পঞ্চশরের বাণাঘাতজনিত বৈকল্য থেকে মুক্ত হতে পারলেন না দেবাদিদেব, নারীর অন্বেষণে বিকলমতি মহাদেব এদিক-সেদিক ধেয়ে গেলেন। তাঁর এহেন উন্মত্ততা দেখে অপ্সরা-কিন্নরীর দল ভীত হয়ে পালাবার পথ পেল না। আত্মরক্ষার্থে ত্রস্ত হয়ে উঠল তিন ভুবনের রমণীকুল। তখন দেবর্ষি নারদ শিবের কাছে এসে হিমালয়-নন্দিনীর সঙ্গে বিবাহ ঘটাবার আশ্বাস দিয়ে দেবাদিদেবের বৈকল্যমুক্তি ঘটালেন। বিবাহ হল, শান্ত হলেন শিব, “উমা পেয়ে মহেশের বাড়িল আনন্দ”। শিবের অনুরোধে উমা তাঁর সঙ্গে একাঙ্গী হলেন, অর্ধনারীশ্বররূপে শিবশক্তির মিলন হল পূর্ণতম, পরমতম।
ভারতচন্দ্র দেখালেন, বলপ্রয়োগে কাম-ধ্বংসের প্রয়াস অসার্থক, তাতে আপাতভাবে কামনাশ হয়েছে মনে হলেও সেই নষ্টভ্রষ্টদমিত অনঙ্গবেগ নানারকম বিক্ষেপকারী বিকলতাকেই ডেকে আনে৷ তার চেয়ে উত্তম – কামকে স্বীকার করা, কামিনীর সঙ্গে যথাযথ বিহারে স্বাভাবিক চিত্ততোষ।
বিদ্যাসুন্দরের প্রসঙ্গে আসি।
বসুমতী সংস্করণের বিদ্যাসুন্দর উপাখ্যানের শুরুতে মঙ্গলকাব্যের ছাঁচ মেনে তৈরী করা একটি কাহিনী স্থান পেয়েছে। তপস্যার ফলে ভৈরব-ভৈরবীরূপ প্রাপ্ত হয়ে কৈলাসে উমা-মহেশ্বরের পার্ষদ হয়েছিল দুই সাধক – যোগানন্দ আর যোগানন্দা। অতিথিরূপে আগত কন্দর্প ও রতিকে দেখে তারা পরিহাস করে বলে – তিন পুরুষে এরা অধর্মাচারী। দ্বাপরলীলায় কৃষ্ণ হরণ করেছিলেন রুক্মিণীকে; কৃষ্ণপুত্র প্রদ্যুম্ন, যিনি স্বয়ং কামদেবের অবতার, তিনি হরণ করেছিলেন লক্ষণাকে; আর প্রদ্যুম্নের পুত্র অনিরুদ্ধ বাণাসুরকন্যা ঊষার সঙ্গে প্রাকবিবাহ রতিরঙ্গে লিপ্ত হয়েছিলেন। বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানটির মর্যাদাহানি ঘটিয়েছেন এঁরা। কামদেবের অপমানে ক্রুদ্ধ দেবাদিদেব এই দম্পতির অহংকারের দণ্ড হিসাবে মর্ত্যে মানবরূপে জন্মগ্রহণ ও ‘অবিভা’ অর্থাৎ বিবাহসম্পর্কহীন প্রণয়যাপনের অভিশাপ দিলেন। তারাই মর্ত্যে এসে জন্মাল , তাদের নাম হল বিদ্যা ও সুন্দর।
বিদগ্ধ ও আধুনিকমনা কবি ভারতচন্দ্র মঙ্গলকাব্যের ছাঁচ মেনে চললেন, অথচ অপূর্ব স্বকীয়তা দেখালেন।
প্রথমত, ‘মদনারি’ নামে পরিচিত মহেশ্বরকে কামদেবের সম্মানরক্ষায় তৎপর সখা হিসাবে দেখিয়ে তিনি মহাদেবকে দিয়ে মদনভস্মের একপ্রকার প্রায়শ্চিত্ত ঘটালেন।
দ্বিতীয়ত, অভিভাবক ও সমাজের অনুমোদনহীন, বিবাহ নামক প্রতিষ্ঠানের বহির্ভূত নরনারীর প্রণয়সম্পর্ককে মর্যাদার আসন দিলেন কবি।
তৃতীয়ত, কাব্যের পরবর্তী অংশে কালী স্বয়ং হয়ে উঠলেন তথাকথিত অধর্ম ও অন্যায় হিসাবে দেগে দেওয়া এই মর্ত্যপ্রেমের সমর্থক ও রক্ষক। পূজাপ্রত্যাশী মঙ্গলদেবীর পরিচিত চরিত্রকে অতিক্রম করে ভারতচন্দ্রের কাব্যে দেবী অবতীর্ণ হলেন এক নূতনতর বৈপ্লবিক ভূমিকায়।
* *
এই উপাখ্যানে দেখি, সুন্দরের চিন্তায় উন্মনা বিদ্যা দেবীপূজা করতে বসে দেবীর বদলে প্রার্থিত পুরুষের চিন্তায় মগ্ন হয়ে গিয়েছে। মানসিক পূজায় পাদ্য, অর্ঘ্য, আচমন, আসন, ভূষণ ও সুগন্ধি মালা দেবীর বদলে অর্পণ করে বসেছে সুন্দরকে। পূজা অঙ্গহীন হয়েছে ভেবে সে যখন ত্রস্ত, তখন আকাশবাণীতে অভয় জানিয়েছেন ইষ্টদেবী – “পূজা না হইল বলি না করিহ ভয়। সকলি পাইনু আমি আমি বিশ্বময়।।”
আবার চৌর্যাপরাধে রাজসমীপে আনীত সুন্দর পঞ্চাশটি দ্ব্যর্থক শ্লোকে প্রিয়তমার যে বিবরণ দিয়েছে, তা এক অর্থে হয়েছে তার মর্ত্যপ্রেয়সী বিদ্যার বর্ণনা, আবার অর্থান্তরে তাই হয়ে উঠেছে অতিমর্ত্য মহাবিদ্যা অর্থাৎ কালীর স্তুতি। বিদ্যা ও সুন্দর – দুজনের ভাবনাতেই এক হয়ে মিলে গিয়েছ মানবিক প্রেমাস্পদ ও ঐশ্বরিক ইষ্টদেবী। এক হয়ে মিশে যায় প্রেম ও পূজা।
‘সোনার তরী’ বইয়ের ‘বৈষ্ণবকবিতা’ থেকে রবীন্দ্রনাথের বাণী ধার করে বলা চলে,
“দেবতারে যাহা দিতে পারি, দিই তাই
প্রিয়জনে– প্রিয়জনে যাহা দিতে পাই,
তাই দিই দেবতায়; আর পাব কোথা !
দেবতারে প্রিয় করি, প্রিয়েরে দেবতা।”
পাঠক খেয়াল করবেন, বিদ্যা ও সুন্দরের প্রণয় উপাখ্যান বর্ণনার সময় কবি প্রায়শই সর্গসূচনায় যোগ করে দিয়েছেন রাধাকৃষ্ণলীলাবিষয়ক পদ, যার সঙ্গে সেই সর্গের ঘটনার কিছুদূর অবধি সাদৃশ্য রয়েছে। অর্থাৎ এই কাব্যে সমান্তরালভাবে বহমান হয়েছে আদিতম ও পরমতম পুরুষ-প্রকৃতির চিন্ময় অপ্রাকৃত নিত্যলীলা, আর মর্ত্যমানুষের সঙ্গে মর্ত্যমানুষীর প্রেমোপাখ্যান। কবি দেখতে পান, কবি দেখাতে চান – ধুলোমাটি-মাখা প্রতিটি পার্থিব প্রেমের শিশিরবিন্দুতেই প্রতিফলিত হয় সেই পরম প্রেমের, সেই নিত্যলীলার সৌরবর্ণালী।
আবার ফিরে যেতে হচ্ছে রবীন্দ্রনাথের কাছে। কিছু করার নেই। রবীন্দ্রনাথও যে আপন সহধর্মিণীর উদ্দেশে (‘স্মরণ’ বইয়ের ২২ নং কবিতায়) লিখেছেন –
“যেভাবে রমণীরূপে আপন মাধুরী
আপনি বিশ্বের নাথ করিছেন চুরি
... যেভাবে পরম এক আনন্দে উৎসুক
আপনারে দুই করি লভিছেন সুখ ,
... হে রমণী, ক্ষণকাল আসি মোর পাশে
চিত্ত ভরি দিলে সেই রহস্য-আভাসে।”
শেষ করার আগে, ছোট্ট একটা প্রসঙ্গ।
অন্নদামঙ্গলে একাধিকবার কবি ভণিতায় ‘রাধানাথ’ নাম উল্লেখ করেছেন দেখে সমালোচকরা অনুমান করেছেন, কবির ধর্মপত্নীর নাম সম্ভবত রাধা।
বিদ্যাসুন্দর কাহিনীতে যেখানে সুন্দর দ্ব্যর্থক শ্লোকপাঠ আরম্ভ করবে, যে শ্লোকাবলীতে একত্রে বন্দিত হবেন বিদ্যা ও মহাবিদ্যা – ঠিক তার আগেই ভারতচন্দ্র সর্গসূচনা হিসাবে রাধাবন্দনা গেয়েছেন –
“মোর পরাণপুতলী রাধা।
সুতনু তনুর আধা।।
দেখিতে রাধায় মন সদা ধায়
নাহি মানে কোনো বাধা।
রাধা সে আমার আমি সে রাধার
আর যত সব ধাঁধা।।”
সুন্দর নিজপ্রিয়ার স্তুতির আড়ালে হরপ্রিয়ার স্তুতি করেছিল।
কবি কি কৃষ্ণপ্রিয়ার স্তুতির আড়ালে নিজের গৃহলক্ষ্মীর স্তুতি করলেন?
“বুঝ লোক যে জান সন্ধান”...
- Get link
- X
- Other Apps
Comments
Post a Comment