রবীন্দ্র-আলোকে ললিত ভারতী—সমীপেষু দাস

Image
  রবীন্দ্র-আলোকে ললিত ভারতী কাব্যসরস্বতী কোনো মন্দিরের বন্দিনী দেবতা নন                                                                                                       ( মধুমঞ্জরি, বনবাণী )                        রবীন্দ্রনাথ কাব্য ও সংগীতকে কখনওই পৃথক ব’লে ভাবতেন না। প্রথম জীবনের তাঁর কাব্যগুলির নামকরণ-ই তার যথাযথ প্রমাণ – সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল  ইত্যাদি। এমনকি যে কাব্যের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান; তা-ও গীতাঞ্জলি। তাঁর রচিত অসংখ্য কবিতা-ই গানের রূপ পেয়েছে। ব্যক্তিজীবনে তিনি তাঁর কাব্যরচনার প্রেয়সীরূপে পেয়েছিলেন তাঁর ‘নতুন বৌঠান’ তথা কাদম্বরী দেবী-কে। তিনি যখন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে আসেন; তখন বয়সে তিনি বালিকা। তাই সেই ছবিই পরবর্তীত...

কালীকথা-২—ধ্যানালোকে দক্ষিণা কালী—ভাস্বর নন্দী

  ধ‍্যানালোকে দক্ষিণা কালী

ভাস্বর নন্দী 

মলিকিউলার বায়োলজি গবেষক

  যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়


 আধ্যাত্মিক পটভূমিতে শ্রী শ্রী কালীর ভূমিকা অপরিসীম। বিষ্ণুক্রান্তার অন্তর্গত বঙ্গদেশ কালীকূলের অন্তর্ভুক্ত এবং জগদম্বা কালী অর্থাৎ প্রথমামহাবিদ্যা দেবীই প্রধান উপাস্যা। জগদম্বিকা কালী স্বয়ং বিশ্বব্রহ্মান্ড প্রসবিনী, জগৎপালিকা এবং সৃষ্টিসংহারনায়িকা। তিনি জগৎপরিব্যাপ্তা, অচিন্তনীয়, জগন্মোহিনী মহামায়া। তাঁর স্বরূপ স্বয়ং ভগবানও উপলব্ধি করতে পারেন না। বিখ্যাত এক কালিকীর্তনে পাই "কালী নামের এতো গুণ, কেবা জানতে পারে তায়, কিঞ্চিৎ জানিয়া শিব তাই পড়েছে রাঙা পায়"। অর্থাৎ সর্বেশ্বর দেবাদিদেব কৌলেশ্বর মহাদেবও মহাকালীর স্বরূপ সম্পর্কে কিঞ্চিৎমাত্র অবগত এবং তাতেই তিনি দেবীর রাতুলচরণে আশ্রয় নিয়েছেন। জ্ঞানবুদ্ধি আশ্রয় করেও আমরা নিমিত্ত মাত্র মানুষ যেটুকু বুঝতে পারি তা কেবল এই সংসারেই সীমাবদ্ধ। চরাচরাধিষ্ঠাত্রী জগন্মাতাকে বোঝার ক্ষমতা আমাদের নেই। যুগাবতার শ্রীরামকৃষ্ণদেব তাঁর সাধনজীবনের সর্বানুভূতির তত্ত্বকে একাত্মিভূত করে বলেছেন " যিনি ব্রহ্ম তিনিই শক্তি" অর্থাৎ ব্রহ্ম ও শক্তি অভেদ। এই তত্ত্বই আসলে ব্রহ্মতত্ত্ব বা শিবশক্তিতত্ত্ব। স্বয়ং সদাশিব মহানির্ব্বাণতন্ত্রে বলেছেন- দেবীই সৃষ্টির আদিতে তমোরূপে, অদৃশ্যরূপে প্রকাশমানা; তাই সেই রূপ অব্যক্ত ও কল্পনার অগোচর। তিনিই পরমব্রহ্মের সৃষ্টি করার ইচ্ছারুপিনী, তাঁর হতেই এই জগতের উৎপত্তি। মহতত্ত্ব হতে মহাভূত পর্যন্ত এই নিখিল জগৎ, তাঁরই সৃষ্টি। সর্ব্বকারণের কারণ পরমব্রহ্ম কেবল নিমিত্তমাত্র। ব্রহ্মসৎরূপ এবং সর্ব্বব‍্যাপি, তিনি সমস্ত জগতকে আবৃত করে রেখেছেন। ব্রহ্ম সর্বদা নিষ্ক্রিয়; তিনি সত্য ও জ্ঞানস্বরূপ, আদ‍্যন্তবর্জ্জিত এবং বাক্যমনের অগোচর। দেবী পরাৎপরামহাযোগিনী, ব্রহ্মের ইচ্ছামাত্র অবলম্বন করে এই চরাচর জগৎ সৃষ্টি, পালন ও সংহার করেন। জগৎসংহারক মহাকাল সেই দেবীর রূপমাত্র; সেই মহাকাল মহাপ্রলয়ে সর্ব্বভূতকে গ্রাস করেন। আর দেবী স্বয়ং মহাকালকেও গ্রাস করেন; তাই তিনি কালিকা। সকলের আদিকালত্ব ও আদিভূতত্ব দেবীতেই নিবন্ধিত, তাই তিনিই আদ‍্যা। প্রলয়ের কালে তিনিও বাক্যের অতীত, বুদ্ধির অগোচর, নিরাকারা স্বরূপা। তিনি সাকারা হয়েও নিরাকারা আবার মায়ার আশ্রয়ে নানান রূপধরে সৃজন, পালন ও নিধনকর্ত্রী। অখণ্ড অদ্বৈতব্রহ্মসমুদ্রে সাকার-নিরাকার, সগুণ-নির্গুণ, ব্রহ্ম-শক্তির এক অপরূপ সহাবস্থান। এক ও অখণ্ড ব্রহ্মচৈতন্যসমুদ্রের জল কখনো নিশ্চল আবার কখনো চঞ্চল। এই অবস্থার পরিবর্তন হওয়া বা না হওয়া অদ্বিতীয়ব্রহ্মের এক ও অন্যরূপ। এই ব্রহ্মময়ী কখনো পুরুষরূপে বা কখনো নারীরূপে অথবা কখনও শূন্য তথা নিষ্ক্রিয় ও নির্গুণ ব্রহ্মসত্তারূপে লীলা করেন। ব্রহ্মও লীলায় বহু ও বিচিত্র কিন্তু এক ও অদ্বিতীয়। ব্রহ্মের ইচ্ছারূপী শক্তি এক ও বহুরূপে নিজেকে প্রকাশ করেন, এ তাঁরই অনুকম্পা মাত্র। শ্রীশ্রী চণ্ডী তে দেবী বলছেন "একৈবাহং জগত‍্যত্র দ্বিতীয়া কা মমাপরা" অথাৎ দেবী ছাড়া এই জগতে দ্বিতীয় আর কেউ নেই। সর্বাত্মকভাবে সমস্ত কিছুর কারণ শুধুই শক্তি বা দেবী। আবার অদ্বৈতবেদান্তে বলে "অহম ব্রহ্মস্মি" অর্থাৎ সবেতেই ব্রহ্মের প্রকাশ। তাই ব্রহ্ম ও শক্তি অভেদ ও অভিন্না। সাধক কমলাকান্ত সেই সত্যের সঠিক উপলব্ধি করে গেয়েছেন "কখনও পুরুষ, কখনও প্রকৃতি কখনো শূন্যরুপা রে"। সাধক রামপ্রসাদ গেয়েছেন-" মায়ের উদরে ব্রহ্মাণ্ড- ভাণ্ড প্রকান্ড তা জান কেমন, মহাকাল জেনেছেন কালীর মর্ম অন্য কেবা জানে তেমন"। শিব-শক্তির তত্ত্ব; ব্রহ্ম ও ব্রহ্মশক্তির রহস্য রামপ্রসাদ বুঝেছিলেন তাই তিনি গেয়েছেন "আমি কালী ব্রহ্ম জেনে মর্ম ধর্মাধর্ম সব ছেড়েছি"। কালীতন্ত্রের যে দক্ষিণকালিকার ধ্যান রয়েছে তা যদি অনুধাবন করা যায়, তবে দেবীর স্বরূপের কিঞ্চিৎ ধারণা আমরা পাই। দেবীর ধ্যানমূর্তি যেন এক বৈপরীত‍্যের সমাহার। একদিকে তিনি ভীষণা, ভয়ঙ্করী, যুদ্ধমূর্তি অন্যদিকে তিনি মাতৃরূপা, মোক্ষদায়িনী, স্নেহময়ী, সুধাদানে ব্যগ্রা। দক্ষিণকালিকা কৃষ্ণময়ী। সকল বর্ণের সমাহারে সৃষ্টি হয় কৃষ্ণবর্ণের। কৃষ্ণবর্ণ লয়াত্মিকা শক্তি। মহাপ্রলয়কালে বিশ্বচরাচর মহাকালীতে লয় হয়। বীজরূপে থাকার নামই লয় হওয়া। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন, "মহাপ্রলয়কালে দেবী সৃষ্টির বীজ কুড়িয়ে রাখেন", অর্থে তিনি পুনরায় সৃষ্টি করবেন। সাংখ্যকার কপিল বলেছেন, কার্যের নাশ বা লয় অর্থে তার কারণে প্রত্যাবর্তন হওয়া- "কলনাৎ সর্বভূতানাং মহাকালঃ প্রকীর্তিতঃ। মহাকালস‍্য কলনাং ত্বমাদ‍্যা কালিকা পরা"।। দেবী ভাগবতেও বলা হয়েছে "কালী কলয়তে সর্বং ব্রহ্মাণ্ডং সচরাচরম্" ।। কল্পান্তসময়ে তিনি সমস্ত গ্রাস করেন তাই তিনি করালবদনা।শ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন "কালী দূরে তাই কালো"। কালীকে কাছে পেলে অর্থাৎ জ্ঞাননেত্র উদ্ভাসিত হলে তখন তিনি "কালোরূপে দিগম্বরী, হৃদিপদ্ম করেন আলো"। তিনি মুক্তকেশী, তাঁর অবিন্যস্ত দীর্ঘ নির্বিকারা আলুলায়িত কেশদাম। কেশ=ক্+অ+ইশ (ক=ব্রহ্ম; অ=বিষ্ণু; ইশ= শিব)। কেশ কে তিনি মুক্ত করেন তাই মুক্তকেশী। অর্থাৎ ব্রহ্মা, বিষ্ণু ও শিবকে তিনি ভুক্তিমুক্তি কৃপা করে প্রদান করেন। আবার মুক্তকেশ মায়াপাশের প্রতীক, তিনি স্বয়ং মায়াতীতা হয়েও জীবকে মায়াপাশে আবদ্ধ করেন। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন "বন্ধন ও মুক্তি, এই দুয়ের কর্তাই তিনি"। আবার মুক্তকেশী স্বয়ং বন্ধনহীনা। তাঁর ঘনকৃষ্ণ কেশরাশি তাঁর চরণস্পর্শ করেছে; অর্থাৎ কেশরাশির ওপরপ্রান্ত অদৃশ্যমান। বলা যেতে পারে পরমব্রহ্মের দ্বার ভগবতী আবদ্ধ করে রেখেছেন। তিনি কৃপাপূর্ব্বক সেই দ্বার উম্মুক্ত করলে তবেই ব্রহ্মপ্রাপ্তি। দেবী চতুর্ভূজা। তাঁর উপরের বামহস্তে জ্ঞানরূপী খড়্গ যাঁর দ্বারা তিনি অজ্ঞানতা, অহং ইত্যাদি নাশ করেন। এই জ্ঞান খড়্গ দ্বারা তিনি রিপুদমন করে তত্ত্বজ্ঞান সঞ্চার করেন। সাধকের মোহপাশ তিনি সেই খড়্গ দ্বারা ছেদন করেন। দেবীর আরেক হস্তে নৃমুণ্ড। সাধকের মুণ্ড দেবী স্বয়ং স্বহস্তে ধারণ করেছেন। আপাতদৃষ্টিতে মনে হতে পারে সমকরকালে মৃত কোনো অসুরের মুণ্ড। কিন্তু স্বামী বিবেকানন্দের ভাষায় উচ্চ সত‍্য হলো এই যে দেবী সাধকের মুণ্ড সদ্য কর্তন করে হস্তে ধারণ করেছেন। কিন্তু প্রশ্ন আসে যে সাধকের মুণ্ড দেবীর হস্তে থাকার কি কারণ বা দেবীর আশ্রিত যিনি, দেবীর তাঁকে বধ করার হেতু কি? মুণ্ড হলো তত্ত্বজ্ঞানের আধারস্বরূপ। দেবী নিরাসক্ত সাধক কে তত্ত্বজ্ঞান প্রদান করেন। মস্তক অহংবোধের প্রতিরূপ তাই তিনি অহংনাশ করেন। মস্তক সমস্ত কর্মের নিয়ন্তা, কর্মনাশ হলেই সাধক দেবীর আশীর্বাদে ভগবতীপ্রাপ্ত হন। দেবীরচরণে নিবেদিত জীবন, সাধক সর্বসময়ে দেবীর হস্তস্পর্শ অনুভব করেন। এ এক চরম বিপরীতধর্মী নিদর্শন যেন। দেবীর দক্ষিণ দিকের দুইহস্তে বর ও অভয়। সমস্ত কার্যের মাঝে যেন মস্তক সর্বদা দেবীচিন্তায় লীন থাকে, দেবীর ধ্যানে রত থাকে। তিনি যন্ত্রী স্বরূপা, এই চিন্তাই যেন সর্বদা তাঁর প্রতি আত্মসমর্পণের পাথেয় হয়। তার ফল স্বরূপ দেবী সাধকের অভীষ্ট বরদান করেন। তাঁর আরও একটি হস্তে অভয় অর্থাৎ তিনি সাধকের মৃত্যুভয় দূর করছেন। 'মাভৈঃ' অর্থাৎ তিনি ভয় দূরীভূত করে সঙ্গে রয়েছেন এবং অহেতুকি কৃপায় জগৎধন্য করে  মুক্তি প্রদান করেছেন। দেবী কালিকা দিগম্বরী। দশদিক তাঁর বস্ত্র তাই তিনি দিগ্বসনা। ব্রহ্ম আবরণ স্বরূপ। জগতের সবচেয়ে সূক্ষ্ম আবরণ হলো মায়া। কালী পূর্ণব্রহ্মময়ী তাই তিনি মায়াতীতা- সকল আবরণমুক্তা। সর্বদিকময়ী, সর্বপরিব্যপ্তা, বিশ্বরূপিনী তিনি, তাই তাঁর আবরণসীমার প্রয়োজন নেই। সৃষ্টির পূর্বতত্ত্ব হতে তিনিই একমাত্র ও একাকিনী, দ্বিতীয় আর কেউ নেই। ব্রহ্মা, বিষ্ণু, শিব তথা এই পূর্ণজগৎ তাঁরই অনুকম্পায় সৃষ্ট। তিনিই সর্বভূতে বিরাজমানা, তিনি ব্যতীত আর কেউ নেই, তাই তিনি দিগ্বসনা। দেবীর তিনটি রক্তাভ নয়ন, তিনি ত্রিনয়না। ভোরের বালসূর্যের মতো আরক্তিম, যুদ্ধমূর্তি নেত্র।  মহানির্ব্বাণ তন্ত্রের মতে তাঁর তিন চক্ষু সূর্য‍্য, চন্দ্র ও অগ্নি তুল্যা। ত্রিনয়নে তিনি কালসম্ভুত অখিল চরাচরের ভূত, ভবিষ্যৎ ও বর্তমান প্রত্যক্ষ করেন। রামপ্রসাদের ভাষায় '"মায়ের আছে তিনটি নয়ন/ চন্দ্র, সূর্য্য আর হুতাশন"। তিনি ঘোরদংষ্ট্রা, অতি ভীষণা। তাঁর লেলিহান রক্তবর্ণ রজোগুণের প্রতীক জিহ্বা সত্ত্বগুণের সূচক শুভ্রদন্তে দংশন করেন। দন্তের শুভ্রতা সত্ত্বগুণের প্রতিষ্ঠা সূচিত করে। দানবনাশের কালে তাঁর মধ্যে তমো ও রজোগুণের আধিক্য হলে তিনি সত্ত্বগুণ প্রতিষ্ঠা করেন। তিনি ত্রিগুণময়ী, ত্রিগুণকারা আবার ত্রিগুণাতীতা। তন্ত্রতত্ত্ব অনুসারে পুরুষ হলেন 'দক্ষিণ' এবং নারী হলেন 'বামা'। যতক্ষন দক্ষিণ ও বাম সমবলে অবস্থিতি করেন, ততক্ষণ সংসারবন্ধন। সাধনায় বাম শক্তি জাগরিতা হলে তিনি দক্ষিণশক্তি কে অধিকার করে নেন এবং দক্ষিণানন্দে নিমগ্না হন। উভয় অংশই তাঁর প্রভাবে পূর্ণ, তিনিই জীবের মহামোক্ষ প্রদানকারী দক্ষিণ কালী। দেবীর দক্ষিণপদ অগ্রে প্রসারিত তাই তিনি দক্ষিণ কালিকা। আবার দক্ষিণ দিকে মৃত্যুরাজ যমের অধিষ্ঠান। দক্ষিণ কালিকা নামে যমও ভীতসন্ত্রস্ত, যম যন্ত্রনা থেকে দেবী সাধককে মুক্ত করেন, রক্ষা করেন। রামপ্রসাদ বলেছেন  "কালী নামের দাওরে বেড়া, ফসলে তছরূপ হবেনা। সে যে মুক্তকেশীর শক্ত বেড়া, তার কাছেতে যম ঘেঁসে না"। স্বয়ং শিব বলেছেন দক্ষিণা যেমন যজ্ঞাদিকর্মের শেষ ও সফলতা প্রদান করে, তেমনি দেবী কালিকা বাঞ্ছিত বর ও মুক্তি প্রদান করেন, তাই তিনি দেবী দক্ষিণ কালী। দেবীর কণ্ঠে রুধিররাক্ত মুণ্ডমালা। মুণ্ড জ্ঞানের আধার; মুণ্ড জ্ঞান ও কর্মের প্রতীক। মুণ্ডহারে মুণ্ড সংখ্যা পঞ্চাশ। তন্ত্রে বলা হয় কালী বর্ণময়ী। এই বর্ণেই সমস্ত দেবতার বীজ মন্ত্রের সৃষ্টি। প্রলয়কালে দেবী সেই বীজ নিজ মধ্যে নিহিত রাখেন। সেই ওঙ্কারময়ী দেবীই পুনঃ পুনঃ সৃষ্টি করেন। বর্ণ বিশ্বসৃষ্টি, বিশ্বতত্ত্ব ও সকল তত্ত্বের মর্মকথা প্রকাশ করে। সাধক রামপ্রসাদ বলেছেন "কালী পঞ্চাশদ্বর্ণময়ী, (তুমি) বর্ণে বর্ণে নাম ধর"। 'অ' থেকে 'অঃ' পর্যন্ত সকল স্বরবর্ণ এবং 'ক' থেকে 'ল' পর্যন্ত সকল ব্যঞ্জনবর্ণই হলো মাতৃকা বর্ণ; মাতৃকা বর্ণই চৈতন্যময়ী অক্ষররূপিণী শব্দব্রহ্মময়ী কালী। মাতৃকাবর্ণই মুণ্ড এবং মুণ্ডমালা। বেদাদি তন্ত্র এবং সর্ব্বশাস্ত্রই এই পঞ্চাশৎ বর্ণে গঠিত বা লিখিত। বর্ণমালাই জ্ঞানমালারূপে দেবীর কণ্ঠভূষণ, তাই দেবী সর্ব্বজ্ঞানময়ী। সেই জ্ঞানস্রোত রুধিররূপে জগন্মাত্রিকার সর্ব্বাঙ্গে প্রবাহিত। সৃষ্টি যখন ছিল না তখনও বর্ণময়ী মহাশক্তিকালী ছিলেন। দেবীর জিহ্বা বহির্দেশে প্রসারিত। তিনি বর্ণময়ী এবং বর্ণের জন্য বিশ্বসৃষ্টির প্রকাশ, তাই বিশ্বরূপীনি জননীর বর্ণপ্রতীক 'জিহ্বা' বহির্দিকে প্রসারিত। শব্দময় ও বর্ণময় এই জগতের তিনি মহাশক্তি। দেবীর জিহ্বা রহস্যময় বর্ণের প্রতীক; দন্তবর্ণ, তালব্যবর্ণ, ওষ্ঠবর্ণ প্রভৃতি সকল কিছুই বাহির জগতে প্রকাশ পায় জিহ্বা সঞ্চালনের মধ্য দিয়ে। সৃষ্টির পূর্বতরে যখন নর ছিল না তখন নরহস্ত ও নরমুণ্ড দেবী আভরণ রূপে কোথায় পেলেন? সাধক কমলাকান্ত তাই এই প্রশ্ন করে গেয়েছেন "ব্রহ্মাণ্ড ছিল না যখন, মুণ্ডমালা কোথায় পেলি"। আবার ধর্মসংরক্ষণের জন্য দানবদলন করেন দেবী, নিহত দানবগণ দেবীর মুণ্ডমালিকা হয়ে তাঁরই স্বরূপ প্রাপ্ত হন। রণমূর্তি হয়েও দেবীর উন্নত পায়োধর তাঁর মাতৃত্বের রূপ প্রকাশ করে। তিনি সদা আপন সুধারসে তাঁর সন্তানদের পালন করছেন। সকল খাদ্য ও বারিসমূহে তাঁর স্তনবিগলিত করুণা, অমৃতরস রূপে বর্তমান এবং জগতের ক্ষুন্নিবৃত্তির নিয়ামক। প্রলয়ঙ্করী হয়েও তিনি স্নেহময়ী, সন্তানবৎসলা, প্রসন্নময়ী, সৃজনী, পরমাপ্রকৃতি। মহামেঘের বা প্রলয়কালের জীমূতের ন্যায় তাঁর গাত্রবর্ণ। তিনি ভীমা, ভীষণা আবার কল্যাণদায়িনী, মোক্ষপ্রদায়িনী। দেবী শবকর্ণভূষণা; দুটি শিশুর শব দেবীর কর্ণের আভরণ। অর্থাৎ শিবরূপি নিষ্কাম, বালকস্বভাব, নির্বিকার সাধকের শিশু সুলভ সরলতা দেবীর অতি প্রিয় তাই তিনি তাকে আপন ভূষণ করে রাখেন। কর্ণের মাধ্যমে সাধক মন্ত্র লাভ করে, অর্থাৎ কর্ণযোনি তে তাঁর পুনর্জন্ম। মন্ত্র ভূষণে সাধক শিবত্ব প্রাপ্ত হলে সাধক দেবীর বিভূষণ রূপে দেবীতেই লীন হয়। দেবীর দুই ওষ্ঠ হতে রুধিরধারা বিগলত, রক্তিমাভ রুধিরধারা রজোগুণের প্রতীক অর্থাৎ দেবী রজোগুণের আধার স্বরূপা। দেবীর কটিদেশে শবহস্ত নির্মিত মেখলা। কটিদেশ অর্থাৎ মণিপুর চক্র, যেখানে ইচ্ছাশক্তি সৃষ্টি হয়। একাধিক হস্ত বহুকর্মের বা প্রবল শক্তির প্রতীক। অর্থাৎ যে স্থানে প্রবল ইচ্ছারূপ ক্রিয়া সৃষ্ট, সেই স্থানেই শক্তি পুঞ্জীভূত হয়েছে। তন্ত্রযোগ ক্রিয়ায় যদি মণিপুর চক্রের ক্রিয়া প্রবলতর হয় তবেই সাধক অনাহত চক্রে সহজভাবেই পৌঁছতে পারেন। দেবী ঘোররাবাং অর্থাৎ হুঙ্কার মাত্রেই তিনি অবলীলায় সংহার করতে পারেন। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বর্ণিত যে "মুক্তানি তেন চাস্ত্রাণি দিব‍্যানি পরমেশ্বরী। বভঞ্জ লীলয়ৈবোগ্রহুঙ্কারোচ্চারণাদিভিঃ"।। শুম্ভাসুরের কর্তৃক নিক্ষেপিত দিব্যাস্ত্র সকল পরমেশ্বরী উগ্র হুঙ্কারেই ভগ্ন করে দেন। দেবী কালিকা উগ্রা, মৃত্যুরুপা, লয়কর্ত্রী। সদাশিব তাঁর মহাপ্রেতাসন। তিনি শ্মশানবাসিনী। সাধকের মনের কামনা-বাসনা নাশ করে হৃদয় শ্মশান করে দেন। স্বামী বিবেকানন্দ ধ্যানচক্ষে প্রত্যক্ষ করেছিলেন সেই মৃত্যুরূপা দেবীকে-"... কালি তুই প্রলয়রূপিনি, আয় মা গো আয় মোর পাশে। সাহসে যে দুঃখদৈন্য চায়, মৃত্যুরে যে বাঁধে বাহুপাশে। কাল-নৃত্য করে উপভোগ, মাতৃরূপা তারি কাছে আসে"। দেবী শ্মশানী, শবশিবাসঙ্গিনী; শ্মশানে জীবের স্থূলদেহ ভস্মীভূত হয়, তাই সেই স্থানেই সংহারকারীনি কালীর আবাস। গুপ্তসাধনতন্ত্রে বলা হয়েছে- "বহ্নিরূপা মহামায়া সত্যং সত‍্যং ন সংশয়ঃ। অতএব মহেশানী শ্মশানলয়বাসিনী"। অর্থাৎ দক্ষিণ কালিকা এই চিতাগ্নিস্বরূপা। সাধকের চিত্তে যখন কামনা বাসনার অগ্নি নির্বাপিত হয়, সেই শ্মশানসদৃশ হৃদয়ে দেবী আবির্ভূতা হন। সাধক তাই গেয়েছেন "শ্মশান ভালোবাসিস বলে শ্মশান করেছি হৃদি। শ্মশানবাসিনী শ্যামা, নাচবি সেথা নিরবধি"।। কালী শিবাগণে পরিবৃতা। শ্রীশ্রীচণ্ডীতে বলা হয়েছে দেবীর শ্রীঅঙ্গ হতে শত শত নিনাদিনী শিবা নির্গত হল। তিনি শবারূঢ়া কিন্তু প্রসন্নবদনা, স্মিতহাস্যময়ী। দেবী শবরূপশিবের বক্ষোপরি দণ্ডায়মানা। কালী মহাকালকেও গ্রাস করেন, তাই কাল তাঁর কাছে অতি তুচ্ছ ও নিষ্ক্রিয়। কাল দেবীর অধীন তাই তিনি শবরূপে দেবীর পদতলে। শব চিৎস্বরূপ নির্গুণব্রহ্মর প্রতীক আর দেবী হলেন স্বগুণ ব্রহ্মরুপিনী সৃষ্টি স্থিতি প্রলয়কারিণী মহাশক্তি। সগুণব্রহ্ম মহাশক্তি নির্গুণব্রহ্মের সহিত অচ‍্যুত হয়ে থাকেন। অদ্বৈততত্ত্বের এবং শিবাদ্বৈততত্ত্বের ভাবরক্ষা করে নির্গুণ ব্রহ্মের ওপর সগুণব্রহ্মের নৃত্যবিলাস। শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব ইঙ্গিত দিয়েছেন " যখন নিষ্ক্রিয় তখন ব্রহ্ম; যখন সৃষ্টি স্থিতি প্রলয় করেন, তখন কালী"। দেবী মহাকালের সাথে বিপরীত-রতাতুরা। এই শব্দটি মানবিক মিলনকে ইঙ্গিত করলেও এতে নিগূঢ় তত্ত্বের ব্যঞ্জনা নিহিত। শবরূপ শিব দেবীর পদতলে সর্বাতীত নির্গুণব্রহ্মস্বরূপে অবস্থান করছেন। তিনিই দেবীর আসন। তিনি স্থিতি রূপ কূটস্থ ব্রহ্ম চৈতন্যের প্রতীক। মহাদেবী মহাকালের সাথে রমন করছেন। মহাকাল ও মহাকালী বস্তুত একই, ব্রহ্মের ইচ্ছা শক্তি। দক্ষিণ কালী একই সঙ্গে পুরুষ ও প্রকৃতি।  সৃষ্টি উন্মুখ ও সৃষ্টিবীজ রূপে সগুণ ব্রহ্ম পুরুষ (অদ্বৈতবেদান্তের মায়াধীশ ঈশ্বর) ও শক্তি (অব‍্যক্ত বা অব‍্যাকৃত দেবী কালী) ভেদে রমনে লিপ্ত। এই মহাকাল ও মহাকালীর কারণরূপে আছে বিন্দু, যেখানে সৃষ্টির স্পন্দন নেই। সেই বিন্দুই হলেন শবরূপ সদাশিব। মহাকাল নৃত্যশীলা ও সচঞ্চলা করেন মহাকালীকে। কালী যখন তাঁর নির্গুণ স্বরূপকে অভিভূত করে সৃষ্টি ইত্যাদি করেন, শিব তখন নির্বিকার, সমস্ত কার্যের অতীত। দেবী তখন সক্রিয়, বিপরীত-রতাতুরা। এই মিলন সাধক কে মহামুক্তি প্রদান করে, জন্মমৃত্যুচক্র থেকে নির্মুক্ত করে। সৃষ্টি, পালন ও সংহার শেষে ব্রহ্ম ও শক্তি পুনরায় চৈতন্যস্বরূপে ব্রহ্মসমুদ্রে স্থির বা বিলীন হয়ে যান। অদ্বৈততত্ত্ব ও শক্তিদ্বৈত তত্ত্বের এ এক অপূর্ব মেলবন্ধন। 


শ্রীশ্রীরামকৃষ্ণদেব বলতেন জগন্মাতা সাকার ও নিরাকার উভয়ই। এই তত্ত্ব যেন পূর্ণতা পায় এখানে। আমরা বর্তমানে যে  দক্ষিণকালী মূর্তি দর্শন করি তা প্রকৃত ধ্যানমূর্তির থেকে পরিবর্তিত।  প্রকৃতপক্ষে দক্ষিণকালী মহাকালের ওপর উপবিষ্ট থাকেন এবং মহাকালের নীচে সদাশিব শবরূপে শায়িত। বর্তমানে অদ্বৈততত্ত্বের মতো শিবাদ্বৈতের ভাবকে রক্ষা করেই একটিমাত্র শিবের ওপর শক্তির নৃত্যবিলাস পরিলক্ষিত হয়। শিবের বক্ষে  দেবীর পা রাখার রহস্য তত্ত্ব হলো: দেবী মহাকালী, মহাকাল শিব ছাড়া আর কেউ নন, তাঁরা অভিন্ন ও অদ্বৈতের দ‍্যোতক। দেবী কালিকা বিশ্বপ্রসবিনী, মহাপ্রকৃতির প্রত্যক্ষ প্রতিমূর্তি। প্রথম বিকাশস্তরে নির্গুণ শবশিবের ওপর সগুণ মহাকাল, তাঁর ওপর দেবী উপবিষ্টা। দ্বিতীয় বিকাশস্তরে দেবী মহাকালের ওপর উপবিষ্টা এবং তৃতীয় বিকাশস্তরে শিবের ওপর দণ্ডায়মানা। দেবীর এই ধ্যানমূর্তি অত্যন্ত গুহ্য এবং অপ্রকাশিত। কোন মূর্তিতে দেবীর পূজা কর্তব্য সেই নিয়ে চিন্তায় নিরত মাতৃ সাধক কৃষ্ণানন্দ আগমবাগীশ দেবীর আদেশ প্রাপ্ত হয়ে সাধকজনের হৃদয়হারিণী দেবী মূর্তির আভাস পান। তাঁর সৃজিত দেবীমূর্তি ক্রমেই প্রচারিত হয় এবং মাতৃজ্ঞানে দেবী পূজার বহুল প্রচার সাধিত হয়। দেবীর এই স্থূলরূপের রূপের ভাবনা বা ধ্যানের দ্বারা মানুষের চিত্ত মোক্ষভিলাষী হয়। তাঁর সূক্ষ্মতত্ত্ব অবলোকন করা বুদ্ধিবাক্যমনের অগোচর।

Comments

  1. মন মুগ্ধকর লেখা

    ReplyDelete
  2. ভীষণ সুন্দর.. এবং অত্যন্ত তথ্য সম্বৃদ্ধ একটি লেখা খুব ভালো লাগলো..

    ReplyDelete
    Replies
    1. Anek anekkkk dhonnobad 💛 Durge raksha❤️

      Delete
  3. Bhishon Shundor lekha 💞💞❤️❤️

    ReplyDelete
    Replies
    1. Anekkkk dhonnobad ❤️ Bhagawati rakhsha ❤️❤️

      Delete
  4. ☝🏻☝🏻🙏🏻🙏🏻🙏🏻🙏🏻Informative

    ReplyDelete
  5. Replies
    1. Anekk bhlobasa nish ❤️ tor thekeooo anekk sahajjo paii sobsomoy .... ❤️❤️❤️ Ur my inspiration

      Delete
  6. মনমুগ্ধ 🙏🌿🙏

    ReplyDelete
  7. Tomar porashuno dekhe ami mugdha tai toh "master mashai" boli

    ReplyDelete
    Replies
    1. Na naa prom kichu noy... Sobb Bhagawati janen... ❤️❤️❤️ Durge raksha

      Delete
  8. আহা অপূর্ব......অসাধারণ সমৃদ্ধ হলাম.....জয় মা..... ��

    ReplyDelete
  9. apurbo!!
    shyama pujar prakalley ae rokom ekti rochona sattie jothajotho. Mon vorey gelo.
    Bhaswar er kache anurord, aevabei PhD er pasapasi sathityo chorcha chalea jao.
    Joy maa

    ReplyDelete
    Replies
    1. Anekkk anekk dhonnobad shrinwanti ❤️ anekkkkk subho kamona.. Bhagawati sorbangin mongol korun

      Delete
  10. অপূর্ব সুন্দর মন ভরে গেল

    ReplyDelete

Post a Comment

Popular posts from this blog

মাতৃরূপেণ—১২, 'অন্নপূর্ণে সদাপূর্ণে....'—শ্রীজীবশরণ দাস

কালীকথা-৩—পরমব্রহ্ম শবরূপ তাই — ড. অর্ঘ্য দীপ্ত কর

মাতৃরূপেণ—৫, বঙ্গ-মননে পরিবার-সমন্বিতা দুর্গা দর্শন—রাধাবিনোদ ঠাকুর