রবীন্দ্র-আলোকে ললিত ভারতী—সমীপেষু দাস

Image
  রবীন্দ্র-আলোকে ললিত ভারতী কাব্যসরস্বতী কোনো মন্দিরের বন্দিনী দেবতা নন                                                                                                       ( মধুমঞ্জরি, বনবাণী )                        রবীন্দ্রনাথ কাব্য ও সংগীতকে কখনওই পৃথক ব’লে ভাবতেন না। প্রথম জীবনের তাঁর কাব্যগুলির নামকরণ-ই তার যথাযথ প্রমাণ – সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল  ইত্যাদি। এমনকি যে কাব্যের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান; তা-ও গীতাঞ্জলি। তাঁর রচিত অসংখ্য কবিতা-ই গানের রূপ পেয়েছে। ব্যক্তিজীবনে তিনি তাঁর কাব্যরচনার প্রেয়সীরূপে পেয়েছিলেন তাঁর ‘নতুন বৌঠান’ তথা কাদম্বরী দেবী-কে। তিনি যখন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে আসেন; তখন বয়সে তিনি বালিকা। তাই সেই ছবিই পরবর্তীত...

কালীকথা-৩—পরমব্রহ্ম শবরূপ তাই — ড. অর্ঘ্য দীপ্ত কর

 পরমব্রহ্ম শবরূপ তাই


দেবী দক্ষিণকালিকার ধ্যানমূর্তিতে দেখা যায় যে স্বয়ং মহাদেব দেবীর চরণতলে শববৎ শায়িত হয়ে রয়েছেন। এই মূর্তিভাবনা সংক্রান্ত একটি কাহিনি শোনা যায় যে একবার রণোন্মত্তা দেবী ক্রোধে হিতাহিতজ্ঞানশূন্যা হয়ে সমগ্র সৃষ্টি বিনাশ করতে উদ্যত হয়েছিলেন বলে তাঁকে শান্ত করতে মহেশ্বর তাঁর পথে শায়িত হয়ে থাকেন। দেবী ভুলবশত নিজ স্বামীর বক্ষে চরণ স্থাপন করেন এবং পরক্ষণেই সেই ভুল বুঝতে পেরে গ্লানি এবং লজ্জায়  জিহ্বাদংশন করেন। যদিও এই কাহিনিটি বৃহদ্ধর্মপুরাণ এবং অদ্ভুত রামায়ণে পাওয়া যায় বলে এটিকে পুরোপুরি অশাস্ত্রীয় বলে উড়িয়ে দেওয়া যায়না, তবুও মনে রাখতে হবে যে এই দুই গ্রন্থে মহাদেব দ্বারা রণোন্মত্তা দেবীকে উক্তভাবে শান্ত করার প্রসঙ্গটি থাকলেও, ‘লজ্জা বা গ্লানি’-কাতরা দেবীর জিহ্বা দংশনের উল্লেখ নেই। এক্ষেত্রে বলে রাখা উচিৎ যে এসম্বন্ধীয় ঐতিহাসিক তথ্য গুলো বিচার করলে স্বীকার করতেই হবে যে এই কাহিনিটি তৈরি হওয়ার বহু আগে থেকেই দেবীর শবারূঢ়া মূর্তিটি প্রচলিত ছিল।

ঐতিহাসিক দৃষ্টিতে কালীমূর্তির বিবর্তনধারাটি দেখলে জানা যাবে যে কালীর প্রাচীনতম রূপ ছিলেন চামুণ্ডা, যিনি মূলস্রোতীয় স্মার্ত ধর্মে প্রবেশ করার পূর্বে ছিলেন শ্মশানবাসিনী, খট্ট্বাঙ্গধারিণী অর্থাৎ কাপালিক আচারে পূজিতা। সেই সূত্র ধরেই তাঁর শব বাহন।   কালক্রমে যখন ব্রাহ্মণ্যধর্মের প্রভাবে ‘তন্ত্র’ একটি Canon রূপে আকার গ্রহণ করে, তখন এই শুষ্কা, বিশীর্ণা চামুণ্ডা বিবর্তিত হয়ে পরিণত হ‌ন দক্ষিণকালিকায়, যিনি শ্মশানবাসিনী হয়েও বরাভয়করা, স্মিতাননা, পীনোন্নতপয়োধরা, এবং ঘোর কৃষ্ণবর্ণা হয়েও শৃঙ্গাররসোল্লাসা রতিপরায়ণা। তার সঙ্গে দেবীর বাহন শবটি পরিণত হয় ‘শিব’ রূপে। তবে এই কথাটিও বলে রাখা প্রয়োজন যে কালীর পদস্থিত শবটি কিন্তু উক্ত কাহিনিতে বর্ণিত তাঁর ‘স্বামী’ নন। সাধকমহলে ইনি দেবীর বাহন রূপে গৃহীত: ‘দেবীবাহনমুত্তমম্’। দেবীর পায়ের তলায় যিনি পড়ে আছেন; তিনি সেই অর্থে ‘শিব’ নন, তিনি ‘শব’। দেবীর ধ্যানে তাঁকে ‘শিবারূঢ়া’ নয়, ‘শবারূঢ়া’ বলা হয়েছে। একথা তন্ত্রে সর্বত্রই স্বীকৃত যে শক্তিস্বরূপ ‘ই’-কার ব্যতীত শিব শব ছাড়া আর কিছুই নন। তাই যখন শিবের যাবতীয় শিবত্বকে অর্থাৎ ‘ই’-কারকে আদ্যাশক্তি নিজের মধ্যে আত্মসাৎ করে নেন, তখনই শিব হন শবরূপী মহাদেব। একদিক দিয়ে দেখলে এই শবটিকে অদ্বৈত বেদান্তের শক্তিশূন্য ব্রহ্মের সঙ্গে তুলনা করা চলে, তবে এক্ষেত্রে মনে রাখতে হবে যে তন্ত্রের দৃষ্টিতে কিন্তু অদ্বৈত বেদান্তের এই শক্তিশূন্য, জড়বৎ নিষ্ক্রিয় ব্রহ্ম কখনোই পরমতত্ত্ব নন। যদি কাশ্মীরীয় শৈবদর্শনের ষট্ত্রিংশৎ তত্ত্বক্রম দিয়ে কালীমূর্তি ব্যাখ্যা করা হয় (কারণ কালক্রমে বঙ্গদেশীয় বা বিষ্ণুক্রান্তার কালীকুলেও ষট্ত্রিংশৎ তত্ত্বক্রমটি গৃহীত হয়েছে), তাহলে এই শববৎ ব্রহ্মকে ৩৪তম তত্ত্ব সদাশিবের সমকক্ষ ধরা যেতে পারে। এই তত্ত্ব সৃষ্ট তত্ত্বসমূহের শেষ সীমা যেখানে ‘ইদং’-রূপে জ্ঞাত বিশ্ব গৌণভাব প্রাপ্ত হয়ে ‘অহং’ভাবের অন্তর্ভুক্ত হয়ে বিরাজ করে । এই সদাশিবকে ছাড়িয়ে সর্বোচ্চ স্তরে বিরাজ করছেন শক্তিতত্ত্ব ও শিবতত্ত্ব, যাঁদের পূর্ণ অদ্বৈত স্বরূপকে শৈবাদ্বৈতবাদী দৃষ্টিতে বলা হয় তত্ত্বাতীত অথচ সর্বতত্ত্বাত্মক পরমশিব (যিনি পূর্ণমাত্রায় পরাশক্তির সঙ্গে অভিন্ন) এবং শাক্তাদ্বৈতে এই পরম স্বরূপই তত্ত্বাতীতা অথচ সর্বতত্ত্বময়ী পরাশক্তি (পরমশিবের সঙ্গে অভিন্না)। কালীমূর্তিতে ইনিই মহাকালের সঙ্গে বিপরীতরতাতুরা কালী, এবং এই সমগ্র মুর্তিটি শবরূপ সদাশিবের উপর অবস্থান করছে। খেয়াল করতে হবে যে এখানে সদাশিব শক্তিহীন শব হয়ে গেলেও সেই শক্তি কিন্তু লুপ্ত হয়ে যাননি, বরং সদাশিবকে ছাপিয়ে উঠে তিনি এখন স্বভৈরবের সঙ্গে স্বমূর্তিতে ব্যক্ত হয়েছেন। তোড়লতন্ত্রে শিব বলছেন,

সংহাররূপিণী কালী যদা ব্যক্ত-স্বরূপিণী।।

তদৈব সহসা দেবি শবরূপঃ সদাশিবঃ।

তৎক্ষণাৎ চঞ্চলাপাঙ্গি সা দেবী শববাহনা।।

(যখন ঊর্ধ্বমুখী সংহারক্রমে অর্থাৎ সৃষ্টির বিপরীত মেরুতে সংহাররূপিণী কালী আত্মপ্রকাশ করেন বা ব্যক্তভাব প্রাপ্ত হন, তখনই সদাশিব শবরূপে পরিণত হন। তখনই হে চপলাঙ্গি, সেই দেবী শববাহনা।)   

বীজবিশেষের ধ্যানমূর্তিতে বর্ণিত শববাহনা কালীর সঙ্গে স্বতন্ত্র ভাবে মহাকালের উল্লেখ না থাকলেও, দেবীর দক্ষিণপার্শ্বে তিনি সর্বদা পূজিত হয়ে থাকেন। এই মহাকালই দেবীর ভৈরব, শবরূপ শিব কালীর ভৈরব নন। সদাশিবের শিবত্বকে আত্মসাৎ ক’রে দেবী তাকে নিজের ভেতর আবার নতুন রূপ প্রদান করেছেন। মহাকালের ধ্যানমন্ত্রে তাঁর যে মূর্তিটি দৃষ্ট হয় তা কালীরই অনুরূপ, তিনি কালীর সঙ্গে অভিন্নতা লাভ করে তাঁরই স্বরূপ লাভ করেছেন। অন্যভাবে বললে তিনি মহাশক্তির মধ্যে অন্তর্লীন পরমশিব। নির্বাণতন্ত্রাদি বহুস্থানে বর্ণিত রয়েছে যে সহস্রারের পরমধামে মহাকালী মহাকালের সঙ্গে অভিন্ন হয়ে চণকাকারে বিরাজ করছেন। একটি চণক বা চানার ভেতর যেমন দুটি দল একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোত হয়ে জড়িত থাকে, তেমনই আদ্যাশক্তির ভেতর শিব ও শক্তি এই দুটিভাবই সমানভাবে বিদ্যমান। 

তবে একথাও মনে রাখতে হবে যে কালীমূর্তিতে শিবশক্তির এই মিলনকে বিপরীতরতি রূপে দেখানো হয়, অর্থাৎ যে রতিক্রিয়ায় পুরুষ থাকে নিষ্ক্রিয় এবং নারীকে দেখা যায় সক্রিয় ভূমিকায়। স্বরূপত অভিন্ন হলেও পরমতত্ত্বের শিবভাব নিষ্ক্রিয় ও শক্তিভাব সক্রিয়। শাক্তমতে, শিবের মধ্যে যা যা ক্রিয়া চলছে, সবই তাঁর স্বরূপভূতা শক্তির অধীন। পূর্ণভাবে নিষ্ক্রিয় বলে কিছুই হয়না, কারণ শিবের নিষ্ক্রিয় বা ‘অস্তিমাত্রম্’-ভাবে অবস্থানটিকে যদি আপাতভাবে স্বীকার করাও হয়, তাহলেও বলতে হবে যে এই ‘অস্তিমাত্রম্’ ভাবটির মধ্যেও ‘অস্তি’-রূপ ক্রিয়াটি চলছেই, যাকে Sir John Woodroffe বলেছেন ‘The Power to Be as opposed  to the Power to Become’ । Be-ing রূপ ক্রিয়া ছাড়া Being  বা অস্তিত্ব সম্ভব নয়। তাই শিবের স্থিরভাব (Being) এবং জগদাকারে লীলায়িত ভাব(Becoming), দুটোই যখন শক্তির উপরই নির্ভর ক’রে রয়েছে, তখন শক্তির বাইরে শিবের কোনো স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বা ক্রিয়া অসম্ভব। মুণ্ডমালাতন্ত্রে শিব স্বয়ং বলছেন যে মহামায়া যখন সগুণা হন, তখন শিবও সগুণ হয়ে যান এবং দেবী যখন নির্গুণস্বরূপে অবস্থিতা তখন শিবও নির্গুণ হন, অর্থাৎ শিব কখন সগুণ হবেন কখন নির্গুণ হবেন, সবটাই শক্তির ইচ্ছাধীন। তাই মহাকাল-মহাকালীর রতিক্রিয়ায় শক্তিরই একক প্রাধান্য। পরমতত্ত্ব এখানে শিবস্বরূপসমন্বিতা পরাশক্তিই, বিপরীতরতাতুরা কালীই এখানে পূর্ণব্রহ্ম। আপন স্বরূপে অন্তর্গূঢ় এই শিবকে তিনি ইচ্ছানুসারে কখনও স্বতন্ত্র সত্তা প্রদান করে বাইরে প্রকট করছেন, কখনও আবার নিজের মধ্যে বিলীন করে নিচ্ছেন। রুদ্রযামলে আমরা দেখতে পাই,


মহাপ্রলয়মাসাদ্য কোটিব্রহ্মাণ্ডনায়িকা।

শিবশক্তিময়ং দেহমেকীকৃত্য সদা স্থিতা।।

বিন্দুব্যাপকরূপেণ স্বরূপং বিভ্রতী পরম্।

এতস্মিন্নেব কালে তু স্ববিম্বং পশ্যতি শিবা।।

তদ্বিম্বং তু ভবেন্মায়া তত্র মানসিকং শিবম্।

সৃষ্টেরুৎপাদনার্থং তু ভর্তৃরূপমকল্পয়ৎ।।


(মহাপ্রলয়ে কোটিব্রহ্মাণ্ডনায়িকা কালী আপন দেহে শিব ও শক্তি, এই দুই ভাবকে এক ও অভিন্নভাবে মিলিত করে সদা অবস্থান করেন। তখন তিনি যে পরম স্বরূপ ধারণ করেন, তা বিন্দু ও ব্যাপকরূপ (শিবরূপে বিন্দু  ও শক্তিরূপে ত্রিকোণাকারে প্রসারময়)। এমন সময়ে যখন সেই শিবা স্ববিম্ব দর্শন করেন, তখনই সেই বিম্ব মায়া রূপে পরিণত হয়, অর্থাৎ শূন্যের মধ্যে রূপ সৃষ্ট হয় এবং এই রূপই দেবীর মনের সিসৃক্ষা থেকে উৎপন্ন শিব। এইভাবে সৃষ্টির উদ্দেশ্যে মহাশক্তি স্বীয় ভর্তাকে কল্পনা দ্বারা সৃজন করেন।)


মহাশক্তি থেকে উৎপন্ন এই শিব সৃষ্টিকার্যে যুক্ত। দেবীর সঙ্গে অভিন্নতা প্রাপ্ত মহাকালকেই তিনি পুত্র রূপে প্রসব করেন ও দেবীর শক্তিতেই পুষ্ট হয়ে মহাকাল জগৎবিলাস করেন। বিপরীতরতাতুরা মূর্তিতে একদিকে আমরা যেমন শিবশক্তির পরম সামরস্যের রূপ দেখি, তেমনই আবার এই সৃজনোন্মুখ ভাবটিও দেখতে পারি। স্বামী বিমলানন্দকৃত কর্পূরাদি স্তোত্রের টীকায় উদ্ধৃত রয়েছে,


যদা সা পরমাশক্তিঃ স্বেচ্ছয়া বিশ্বরূপিণী।

অধঃকৃত্বা তু পুরুষং সঙ্গমেচ্ছাহভবত্তদা।।

তদাক্রম্য স্বয়ং দেবী ভৈরবোপরি সংস্থিতা। 

সহজানন্দসন্দোহৈঃ নিজানন্দপ্রবর্ধিনী।।


যখন সেই পরমাশক্তি স্বেচ্ছায় বিশ্ব-আকারে পরিণত হন, তখন তিনি পুরুষকে অধঃকৃত করে তাঁর সঙ্গে সঙ্গমের ইচ্ছা করেন। এইভাবে ভৈরবকে আপন প্রভাবে  অভিভূত করে তিনি তাঁর উপর উপবেশন করেন ও সহজানন্দতরঙ্গে নিজানন্দ বর্ধন করেন।)


এই মহাকাল কে কেটে কেটে তিনি তৈরি করেন অনন্ত খণ্ডকাল। আবার মহানির্বাণের মুহূর্ত আগত হলে খণ্ডকালময় সমস্ত জগৎকে মহাকাল গ্রাস করেন এবং সব শেষে এই মহাকালকে গ্রাস করেন স্বয়ং মহাকালী। মহানির্বাণ তন্ত্রে বলা হয়েছে, 


তব রূপং মহাকালো জগৎসংহারকারকঃ।

মহাসংহারসময়ে কালঃ সর্বং গ্রসিষ্যতি।।

কলনাৎ সর্বভূতানাং মহাকালঃ প্রকীর্তিতঃ।

মহাকালস্য কলনাৎ ত্বমাদ্যা কালিকা পরা।।

কালসঙ্কলনাৎ কালী সর্বেষামাদিরূপিণী।

কালত্বাদাদিভূতত্বাদাদ্যা কালীতি গীয়তে।।

পুনঃ স্বরূপমাসাদ্য তমোরূপং নিরাকৃতি।

বাচাতীতং মনোহগম্যং ত্বমেকাবশিষ্যসে।।


(জগৎসংহারকারী মহাকাল তোমার রূপ। মহাসংহারসময়ে এই কাল সব কিছু গ্রাস করেন এবং এই কারণে তিনি মহাকাল নামে কথিত হন। কিন্তু তুমি মহাকালকেও কলন করো, তাই তুমি পরমা কালিকা। কালকে কলন করো, তুমিই সকলের আদিরূপিণী কালী, এবং কালেরও কাল বলে তুমিই আদিভূতা আদ্যাকালী। মহাকালকে গ্রাস ক’রে তুমি পুনরায় আপন নিরাকার, বাচাতিত, মনের অগম্য এবং সেই কারণে তমোময় [অজ্ঞেয় অর্থে] স্বরূপ ধারণ করে একাকিনী বিরাজ করো।)   


 মহাকালকে আত্মসাৎ করার কারণে তিনি যেমন একদিকে ‘আদ্যাকালী’ নামে কীর্তিতা হন, তেমনই তাঁর ‘দক্ষিণাকালী’ নামটিরও এই বিশেষ ক্রিয়াটির সঙ্গে যোগ রয়েছে। নির্বাণ তন্ত্রমতে,

পুরুষো দক্ষিণঃ প্রোক্তো বামা শক্তির্নিগদ্যতে।

বামা সা দক্ষিণং জিত্বা মহামোক্ষপ্রদায়িনী।

অতঃ সা দক্ষিণা কালী ত্রিষু লোকেষু গীয়তে।


মহামহোপাধ্যায় শিবচন্দ্র বিদ্যার্ণব এই শ্লোকসমূহের ব্যাখ্যা করে বলেছেন, 


পুরুষের নাম দক্ষিণ (দক্ষিণাঙ্গ-স্বরূপ বলিয়া), শক্তির নাম বামা (বামাঙ্গ-স্বরূপ বলিয়া) যতদিন এই বাম ও দক্ষিণ, স্ত্রী  ও পুরুষ সমবলে অবস্থিত ততদিনই সংসারবন্ধন। সাধনার প্রখর প্রভাবে বামাশক্তি জাগরিতা হইলে তিনি যখন দক্ষিণ-শক্তি পুরুষকে জয় করিয়া তদুপরি স্বয়ং দক্ষিণানন্দে নিমগ্না হয়েন অর্থাৎ কি বাম, কি দক্ষিণ উভয় অংশই যখন তাঁহার প্রভাবে পূর্ণ হইয়া যায়, তখনই সেই কেবলানন্দরূপিণী জীবের মহামোক্ষ প্রদান করেন। তাই ত্রৈলোক্যমোক্ষদা মায়ের নাম- দক্ষিণা কালী।


দেবীর দক্ষিণচরণ তলে মহাকাল নিষ্চেষ্ট শব হয়ে অবস্থানটিকেও তিনি এই তত্ত্ব দিয়েই ব্যাখ্যা করেন। নির্বাণতন্ত্রে আরো বলা রয়েছে,


নির্গুণঃ পুরুষঃ কাল্যা সৃজ্যতে লুপ্যতে যতঃ।

অতঃ সা দক্ষিণাকালী ত্রিষু লোকেষু গীয়তে।।


যেহেতু কালী নির্গুণ পুরুষকেও সৃষ্টি করে পুনরায় লুপ্ত করতে দক্ষ, তাই তিনি ত্রিলোকে দক্ষিণাকালী নামে বিখ্যাতা।


এক্ষেত্রে এটাও উল্লেখযোগ্য যে শবরূপ শিব আর মহাকালের এই সূক্ষ্ম ভেদটি বহু জায়গায় যেমন প্রকট, তেমনই অনেক স্থানেই এই বিভাজনটি অস্পষ্ট। সেখানে বিপরীতরতির প্রভাবে মহাকালই শব রূপে পরিণত হন। বহু সাধকের ব্যাখ্যায় কালীর এই লয়মুখী ক্রিয়াটিকেই বিপরীতরতির তত্ত্ব হিসেবে  ব্যাখ্যা করা হয়। এই ব্যাখ্যা অনুসারে সামান্য রতি এবং বিপরীতরতির প্রভেদ এই যে সামান্যরতি সৃষ্টিমুখী। এই রতিক্রিয়ায় তেজ ও শক্তির গতি নিম্নমুখী, যেহেতু এর দ্বারা সন্তান উৎপাদন হয়, এক থেকে বহু হওয়ার কার্যটি এতে সম্পাদিত হয়। বিপরীতরতিতে ঠিক এর বিপরীতমুখী গতিটি দৃষ্ট হয়। সেখানে তেজের প্রবাহ ঊর্ধ্বমুখী বা লয়মুখী, যার প্রভাবে নিম্নচক্রস্থিতা কুলকুণ্ডলিনী ঊর্ধ্বগতি লাভ করেন এবং বহুত্ত্বকে নিজ মহানির্বানময়ী এক অদ্বিতীয় কালীস্বরূপের মধ্যে বিলীন করেন। ভৈরবত্বপ্রাপ্ত সাধকের সমস্ত শিবত্ব বা তেজকে তিনি শোষিত করে গ্রাস করেন এবং তাঁকে শবে পরিণত করেন।


এই সকল উদাহরণ একসঙ্গে দেখলে বোঝা যাবে যে শবশিবের উপর বিপরীতরতাতুরা কালীমূর্তি সাধকদৃষ্টিভেদে একাধারে শিবশক্তির পূর্ণ সামরস্য, সৃষ্টি এবং লয়, সবক্ষেত্রেই গুরুত্ত্বপূর্ণ অর্থ বহন করে। কেউ কেউ একে সাংখ্য কিংবা মায়াবাদী দৃষ্টি দিয়েও ব্যাখ্যা করার চেষ্টা করেন, কিন্তু সাংখ্য বা শাঙ্কর বেদান্তের  সিদ্ধান্তের সঙ্গে তন্ত্রের শাক্তাদ্বৈতবাদ বা পূর্ণাদ্বৈতবাদের কিছু মৌলিক বিরোধ থাকায় তন্ত্র নির্ভর ব্যাখ্যাগুলোই সর্বাগ্রে গ্রহণযোগ্য।

ডঃ অর্ঘ্য দীপ্ত কর

     চিত্রশিল্পী, গবেষক ও অধ্যাপক 

সোনারপুর মহাবিদ্যালয়

 লেখকের নিজের আঁঁকা ছবিই প্রথমে ব্যবহার করা হয়েছে।


Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

মাতৃরূপেণ—১২, 'অন্নপূর্ণে সদাপূর্ণে....'—শ্রীজীবশরণ দাস

মাতৃরূপেণ—৫, বঙ্গ-মননে পরিবার-সমন্বিতা দুর্গা দর্শন—রাধাবিনোদ ঠাকুর