রবীন্দ্র-আলোকে ললিত ভারতী—সমীপেষু দাস

Image
  রবীন্দ্র-আলোকে ললিত ভারতী কাব্যসরস্বতী কোনো মন্দিরের বন্দিনী দেবতা নন                                                                                                       ( মধুমঞ্জরি, বনবাণী )                        রবীন্দ্রনাথ কাব্য ও সংগীতকে কখনওই পৃথক ব’লে ভাবতেন না। প্রথম জীবনের তাঁর কাব্যগুলির নামকরণ-ই তার যথাযথ প্রমাণ – সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল  ইত্যাদি। এমনকি যে কাব্যের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান; তা-ও গীতাঞ্জলি। তাঁর রচিত অসংখ্য কবিতা-ই গানের রূপ পেয়েছে। ব্যক্তিজীবনে তিনি তাঁর কাব্যরচনার প্রেয়সীরূপে পেয়েছিলেন তাঁর ‘নতুন বৌঠান’ তথা কাদম্বরী দেবী-কে। তিনি যখন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে আসেন; তখন বয়সে তিনি বালিকা। তাই সেই ছবিই পরবর্তীত...

কালীকথা-৫—রামপ্রসাদী গান : লোকগীতি না ভক্তিগীতি ?—সমীপেষু দাস

  রামপ্রসাদী গান : লোকগীতি না ভক্তিগীতি ? 


—সমীপেষু দাস

অধ্যাপক, বঙ্গবাসী ইভিনিং কলেজ

        খ্রিস্টিয় আঠারো শতকে বাংলার সন্তান রামপ্রসাদ সেন তাঁর সাধনলীলায় যেভাবে শাক্তগীতিকে স্থান দিয়েছিলেন, তা অতুলনীয়। কুমারহট্টে ( বর্তমানে উত্তর চব্বিশ পরগণার হালিশহরে ) তাঁর জন্ম। জনশ্রুতি আছে নদিয়ার মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র রায় একবার কুমারহট্টে ভ্রমণকালে তাঁর গান শুনে মুগ্ধ হন। তারপরেই  তাঁর সভায় তাঁকে আমন্ত্রণ জানান কিন্তু সেই প্রস্তাব তিনি খারিজ করেন। তখন রাজা তাঁকে ‘কবিরঞ্জন’ উপাধি দেন এবং কিছু নিষ্কর জমি দান করেন। কবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র যে কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের সভাতেই ছিলেন,তার বহুবিধ প্রমাণ রয়েছে এবং তিনি তাঁর ‘অন্নদামঙ্গল’ কাব্যে রাজসভার বর্ণনাও করে গেছেন অতিরঞ্জিত ও আংকারিক ভঙ্গিতে-

চন্দ্রে সবে ষোল কলা হ্রাসবৃদ্ধি তায়।

কৃষ্ণচন্দ্র পরিপূর্ণ চৌষট্টি কলায়।। 

…….. 

চন্দ্রের হৃদয়ে কালী কলঙ্ক কেবল। 

কৃষ্ণচন্দ্র হৃদে কালী সর্ব্বদা উজ্জ্বল।।

কিন্তু রামপ্রসাদ সেনের রচনায় সেরকম কোনও স্তুতি নেই। তাঁর পদাবলির মাত্র একাধিক স্থানেই আমরা কৃষ্ণচন্দ্র রায়ের নাম পাই –

প্যাদার রাজা কৃষ্ণচন্দ্র, তা’র নামেতে নিলামজারি। 

বোঝাই যায় বঙ্গেশ্বরের কাছে রাজার নয় লক্ষ টাকা ঋণ থাকায় তিনি কারারুদ্ধ হয়েছিলেন এবং জনশ্রতি অনুসারে যার ফলে কৃষ্ণনগরে জগদ্ধাত্রী পুজোর প্রচলন ঘটে। একজন মহারাজার পক্ষে এহেন ঘটনা নিন্দনীয় কিন্তু তিনি সত্যকে গোপন না ক’রেই এই ইতিহাসের ইঙ্গিত দিয়েছেন। সাধক রামপ্রসাদ আমৃত্যু তিনি শাক্ত সাধনা করেছেন এবং বেশ কিছু গান রচনা করেছিলেন। তিনি যে গানগুলি রচনা করেছিলেন, সেগুলি কিন্তু কোনও বাণিজ্যিক সাফল্যের জন্য বা কারোর প্ররোচনায় নয়। মূলতঃ বিশ শতকে অধ্যাপক,গবেষকরা তাঁর গানগুলির শ্রেণিবিভাগ ক'রে তিনভাগে ভাগ করেছিলেন- ‘আগমনী’, ‘বিজয়া’ এবং ‘ভক্তের আকুতি’। যদিও অমরেন্দ্রনাথ রায় সম্পাদিত ‘শাক্ত পদাবলী’-র সংকলনগ্রন্থে ‘জগজ্জননীর রূপ’, ‘মনোদীক্ষা’ এরকম কিছু বিভাগ-ও রয়েছে। তবুও দেবী দুর্গা বা ‘উমা’-র গানগুলি প্রথমোক্ত দুটি বিভাগে এবং দেবী কালীবিষয়ক পদগুলি শেষোক্ত বিভাগে অন্তর্গত। উমা বিষয়ক পদাবলিতে রয়েছে মায়ের মেয়ের প্রতি বাৎসল্য । শরৎকালে উমা কৈলাস থেকে মর্ত্যে এসে বাপের বাড়িতে এসে নবমীর রাত পোহালেই পুনরায় মহাদেবের সাথে কৈলাসে ফিরে যায়। এখন এই গানগুলিতে যেমন সমাজচিত্র এসেছে যথা বল্লাল সেনের কৌলীন্য প্রথার জেরে মেয়েদের খুব অল্প বয়সেই বিয়ে হয়ে যেত এবং ভরা যৌবনে হয়তো তাকে কোনও অশীতিপর বৃদ্ধের সাথে সংসারযাপন করতে হতো; ঠিক তেমনই এর পাশাপাশি এক দার্শনিক যুক্তি সূক্ষ্মভাবে রয়েছে। সংসারে মায়ার বন্ধন কাটিয়ে সাধক তার সাধনপথে ব্রতী থেকে সিদ্ধিলাভ করে। তাই উমা মেনকার বন্ধনকে উপেক্ষা করে শেষ পর্যন্ত মহাকালের সাথে মিলিয়ে যায়। তাই তাঁর ‘আগমনী’ বা ‘বিজয়া’-র পদগুলিতে মেনকার সংলাপ পাই। এখানে রামপ্রসাদ নিরপেক্ষ। অথচ তাঁর কালীবিষয়ক পদে তিনি সরাসরি উপস্থিত। তিনি নিজে কালিকার অভয়চরণ প্রার্থনা করছেন এবং মহাদেবের সাথে তিনি যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। দেবীর চরণতলে শিব থাকেন ব’লে তিনি যেন দেবীর সামান্যতম কৃপা থেকেও বঞ্চিত। এমনকি যোগদর্শনের অতি নিগুঢ় কুলকুণ্ডলিনী শক্তির কথাও বলেছেন যাকে নাগরূপে কল্পনা ক’রে দেহের ষটচক্র ভেদ ক’রে সহস্রার চক্রে স্থাপন করতে হয়। তাই তিনি বলেছেন -

জাতি ধর্ম সর্প খেলা,

সেই মন্ত্রে করোনা হেলা

আবার ষড়রিপুতে আগল দেওয়ার কথাও আমরা প্রত্যক্ষভসবে তাঁর একাধিক পদে পাই। যেমন – 

এক আসামী ছয়টা প্যাদা, বল মা কিসে সামাই করি।

এই ষড়রিপুকে পরাস্ত করতে পারে বুদ্ধি। কঠ-উপনিষদে বলাই ছিলো বুদ্ধি হচ্ছে রথের সারথি এবং সে-ই লাগামে রাশ টানতে পারে। তিনি যে স্থানে জন্মেছিলেন, সেই স্থান জ্যোতিষবিদ্যার অন্যতম পীঠস্থান ছিলো ব’লেই স্বীকার করতে হয়। তাই তিনিও সেই বিদ্যার সাথে যথেষ্টই পরিচিত ও অভিজ্ঞ ছিলেন। “মন কেন মায়ের চরণছাড়া” পদটি এই প্রসঙ্গে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এই পদেই একবার বলা হয়েছে –

মা ভক্তে ছলিতে তনয়ারূপেতে, বেঁধে গেলেন ঘরের বেড়া।।

আবার ভণিতায় তিনি বলছেন-

তখন একবার এসে কন্যারূপে, রামপ্রসাদের বেঁধো বেড়া।।


প্রথমবারের তনয়ারূপের এই শব্দগুলির সাথেই একটি লোককথা বহুল প্রচলিত। রামপ্রসাদের মেয়ে জগদীশ্বরীর রূপ ধরে এসে স্বয়ং দেবী তাঁর বাড়ির চারপাশে বেড়া বেঁধে দিয়েছিলেন কিন্তু শেষের দিকে ‘কন্যা’ শব্দটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের শব্দ। বারোটি রাশির মধ্যে ষষ্ঠ রাশি হলো কন্যা এবং এই রাশির অধিপতি বুধ গ্রহ। এই গ্রহের প্রভাবেই মানুষের বুদ্ধির বিকাশ হয়। সংস্কৃতে ‘বুদ্ধি’ শব্দটি ক্তিন্ প্রত্যয়ান্ত হওয়ায় এটি স্ত্রীলিঙ্গের শব্দ। এখন ‘কন্যা’ বলতে আমরা কোনও আঠারো বছরের নিচের বালিকাকে বুঝে থাকি। যেহেতু মূল শব্দটি স্ত্রীলিঙ্গের; তাই সেটিকে বোঝাতেই জ্যোতির্বিজ্ঞানে ‘কন্যা’ শব্দ উল্লিখিত হয়েছে। তাই এক্ষেত্রে দর্শনগত দিক থেকে রামপ্রসাদের ঔরসজাত কন্যাসন্তান নয়; সেটি বুদ্ধি। সেই বুদ্ধি-ই কাম, ক্রোধ, লোভ, মোহ, মদ ও মাৎসর্যকে মন থেকে দূরে সরায় মনকে বেড়ি পরিয়ে বা বেড়া বেঁধে। ফলে ইন্দ্রিয়বাসনায় একটি ছেদ পড়ে। সুতরাং ভারতীয় দর্শনের প্রভাব এবং ভক্তির পরাকাষ্ঠা তাঁর পদে সর্বত্র ছড়িয়ে আছে। এছাড়াও তাঁর সমসাময়িক সময়ে বাংলায় ভাগীরথীর পশ্চিম পাড়ে ঘটেছিলো বর্গীদের আক্রমণ এবং সেটি আলিবর্দি খানের সময়কালে। ফলে একদিকে পলাশীর যুদ্ধ, চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের জেরে বাংলা সত্যিই তখন বসনহারা। তাই অবস্থায় দেবী কালিকার ছবি প্রথমেই মাথায় আসবে। কালীকীর্তনমূলক যে গানগুলি রামপ্রসাদ সেন রচনা করেছিলেন, সেগুলি কিন্তু শুধুমাত্র রচনা বা গাওয়ার জন্যই নয়; বরং তার মনের আর্তি গানগুলির মধ্যে ফুটে উঠেছিলো। সবার প্রথমে তিনি তো বাংলা প্রকৃতির খুব কাছের একজন সন্তান, তাই তৎকালীন পরিস্থিতিকে উপেক্ষা করতে পারেননি , তাই গানের মধ্যে বলে উঠলেন- 

যে বাপ বিমাতারে শিরে ধরে, এমন বাপের ভরসা বৃথা

কালীকীর্তনের গানেও পুরুষের বহুবিবাহ, বিমাতার গঞ্জনা- এই ছবি এসে পড়ল। তন্ত্রে যে যোগাচারের কথা বলে হয়েছে এবং কালীমূর্তির রহস্য নিয়ে যে দার্শনিক তত্ত্ব ব্যাখ্যাত হয়েছে, রামপ্রসাদী গীতিতে সেই তত্ত্ব থাকলেও বাংলার পল্লীজীবনের সুরভি না এসে থাকতে পারেনি। শশিভূষণ দাশগুপ্ত ‘ভারতের শক্তি-সাধনা ও শাক্ত সাহিত্য’-তে বলেছেন- “মাকে লইয়া বাংলাদেশের জনমনেরই‌ এক মধুর রসের দিকে ঝোঁক।” রামপ্রসাদী গানে কবি নিজে হয়েছেন ‘সন্তান’ এবং দেবী হয়েছেন ‘মা’। পরবর্তী কালে কাজী নজরুল ইসলামের লেখা গানে এই ভাবই ফুটে উঠেছে কিন্তু একটু পার্থক্য আছে। তিনি বলছেন-

আমার কালো মেয়ে রাগ করেছে

………….

পরেনি সে বসনভূষণ, বাঁধেনি সে কেশ।

তারি কাছে হার মান রে ভুবনমোহন বেশ।

এ যেন বাপ-বেটির খুনসুঁটি। অথচ এই নজরুলগীতি কিন্তু একটি বিশেষ কোঠায় রক্ষিত কারণ কবি নিজে তার বিভিন্ন গানে বিভিন্ন রাগ-রাগিনীর প্রয়োগ করে সুরারোপ করেছেন। 


বাংলায় লোকগানের মধ্যে যেগুলি পড়ে যেমন বাউল, কীর্তন,ভাটিয়ালি,ঝুমুর ,ভাওয়াইয়া ধামাইল এই প্রতিটি গানই হয় কোনও অঞ্চলকে কেন্দ্র ক’রে সেই অঞ্চলের সুরে গাওয়া হয়েছে নয়তো কোনও সম্প্রদায়ের মধ্যে লালিত-পালিত হয়েছে। এখন একটি বিষয় আমাদের মাথায় রাখা প্রয়োজন যে ‘লোকগীতি’ কিভাবে এই সংজ্ঞাটি পায়! গান হতে গেলে কথা, সুর, ছন্দ, তাল, লয় এবং রাগ-রাগিনী তার অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ হয়ে পড়ে। কথা বা বাণীর প্রসঙ্গ যদি দেখি,তবে বলতে হয় যে বাউল গানেও সাধনতত্ত্ব, দেহতত্ত্ব, গুরুতত্ত্ব এরকম বেশ কিছু পর্যায় রয়েছে। লালন সাঁইয়ের খুব পরিচিত একটি পদেই পাই –

ধরতে পারলে মন-বেড়ী দিতাম তাহার পায়।।

              আবার উত্তরবঙ্গের রাজবংশী সম্প্রদায়ের গান ‘ভাওয়াইয়া’-তেও দেখি হাতির পায়ে বেড়ি বাঁধার কথা বলছে । গরুর গাড়ির গাড়োয়ান বা মইষাল কৃষক বা মাহুতেরা। আমাদের জীবনের সুতো ঈশ্বরের হাতেই রয়েছে। তিনি যেমন চালনা করেন, তেমনই আমরা পথে চলতে থাকি। তাই মাহুত বন্ধুরা হাতির গলায় কখনও দড়ি পরায়, আবার তাকে নিয়েই জীবনযাত্রা অতিবাহিত করে। এই 'দড়ি পরানো' যেন সেই অদৃশ্য সুতোরই প্রতীক। 

            অন্যদিকে ভাটিয়ালি গানে ‘ছয়খান দড়ি’ প্রকৃতপক্ষে ষড়রিপু-ই। ইতিহাসে তাঁর তিরোধানের পরেই সংস্কৃতি সুতানুটী-ডিহি কলিকাতাকেন্দ্রিক হয়ে পড়ে। বাংলায় রামপ্রসাদ সেনের আবির্ভাবের বহু পূর্বেই চণ্ডী, কালীকে নিয়ে গ্রামাঞ্চলে ‘মালসি’ নামের এক ধরণের গানের চল ছিল এবং সেগুলি মালবশ্রী রাগে গাওয়া হ’ত।অন্যদিকে সাধক কবি রামপ্রসাদ তাঁর সমস্ত গানে মাত্র একটিই সুর ফেলেছেন, যার ফলে নামই হয়ে গেছে- ‘রামপ্রসাদী সুর’। তাঁর গানে বিষয়গত পার্থক্য তো রয়েছেই উমাবিষয়ক পদে বা কালী বিষয়ক পদে কিন্তু সুরের তেমন হেরফের ঘটেনি। যেমন মধ্যযুগীয় সাহিত্যে চোদ্দ অক্ষরে লেখা পয়ার ছন্দের পদগুলিকে ঘরোয়া পাঁচালি আঙ্গিকে পাঠ করা যায়। লক্ষ্মীপুজোর পাঁচালিতেও বা কৃষ্ণের অষ্টোত্তর শতনাম-এও একটিই সুর বারে বারে ফিরে আসে। অথচ তা শ্রতিকটূ হয়না। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর-ও ‘বাল্মীকি-প্রতিভা’ গীতিনাট্যের “শ্যামা, এবার ছেড়ে চলেছি মা” গানে এই সুর বসিয়েছিলেন। এই সুর এসেছে নদিয়া অঞ্চলের কীর্তনের সুরের স্পর্শে। সেই কারণেই এখন রামপ্রসাদী গান যদি গাওয়া হয়, তার সঙ্গে শ্রীখোলের সঙ্গত অবধারিত। বাউলগানেও কিন্তু কোনও নির্দিষ্ট সুর নেই। লাইন সাঁই কুষ্টিয়া অঞ্চলে যে গানগুলি রচনা করেছেন, সেখানেও নদিয়ার কীর্তনের সুরের প্রভাব পড়েছে। শাহ্ আব্দুল করিম যিনি নিজেকে ভণিতায় ‘বাউল’ বলেছেন, তাঁর গানে নিম্ন জলাভূমি বা ভাটি অঞ্চলের সুর মিশেছে এবং রাঢ় বাংলায় এসেছে ঝুমুর সুরের প্রভাব। যেমন “খেজুর গাছে হাঁড়ি বাঁধো মন”। তাই ‘লোকগীতি’ কখনওই গানের কথার ওপর ভিত্তি ক’রে একটি আলাদা শ্রেণি বা কোঠা পায় না; পায় শুধু তার সুরের চলনের জন্য। 

         এছাড়াও রামপ্রসাদী গানের ক্ষেত্রে তার ব্যবহার আমাদের দেখতে হবে। বাংলায় কার্তিক মাসের অমাবস্যায় কালীপুজো উপলক্ষ্যে এই গান এবং এর, পাশাপাশি কমলাকান্ত ভট্টাচার্য সহ বেশ কিছু গীতিকার-সুরকারদের গান বাজতে থাকে বা গায়ক-গায়িকারাও অনুষ্ঠানে গেয়ে থাকেন। ফলে একটি পুজোকে ঘিরেই এর ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। যে কোনও লোকগানের আসরে বাউল, সারি, ভাটিয়ালি, ঝুমুর এই ধরণের গান যে মাত্রায় গাওয়া হয়, তার চেয়ে রামপ্রসাদী গান অনেক ছোট গণ্ডির মধ্যেই গাওয়া হয়ে থাকে। একই কথা কীর্তনের জন্যও প্রযোজ্য। এরই ফলে এই গানের তকমা ‘ভক্তিগীতি’-র মধ্যেই রয়ে গেছে এবং বাঙালি-ও এই গানকে ‘ভক্তিগীতি’ বা ‘শ্যামাসংগীত’ হিসেবে মানতেই যেন বেশি স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। অমর পাল ও দুলাল চৌধুরী সম্পাদিত ‘বাঙলার লোকসঙ্গীত’ গ্রন্থেও বলা হয়েছে –

“এছাড়াও পল্লীতে রচিত হয় ও সুরারোপিত এমন অনেক গান আছে যাকে পল্লীগীতি পর্যায়ে ফেলা হয় না : যেমন রামপ্রসাদী, শ্যামাসঙ্গীত ইত্যাদি।”

তাহলে এর থেকে এই ধারণা পরিষ্কার যে বাকি লোকসংগীতের ধারার সাথে এর অন্তরঙ্গ মিল রয়েছে। বাউল-ও একটি সাধনা। আবার, ভাটিয়ালি গানেও কোনও এক ‘মমন-মাঝি-র কাছে যাত্রীর আকুতি। তবুও যেহেতু ‘মন-মাঝি' বা ‘অচিন পাখি’ এদের রূপ দিয়ে ঘটা ক’রে নির্দিষ্ট তিথিতে পুজোর কোনও বিধি বা আচার নেই এবং দেবী কালিকার বিশেষ সময়েই পুজো হচ্ছে, ভক্তের দল দেবীর উদ্দেশ্যে অঞ্জলি দিচ্ছে, প্রসাদ গ্রহণ করছে; ফলে মানসিকভাবে এর আবেদন হয়েছে ভক্তিমূলক। দুর্গাপুজোর সময়েও ‘আগমনী’ গান শোনা যায় কিন্তু ‘উমা’-কে রামপ্রসাদ সেন দেবীর আসন দেননি যেখানে কালীকে তিনি মনপ্রাণ এক ক’রে ভজনা করতে চেয়েছেন এবং অনুগ্রহ লাভ করতে চেয়েছেন। 

           তাই রসিকের কাছে  শুধুমাত্র দীপান্বিতা অমাবস্যার শ্যামাপুজোর উপলক্ষ্যেই নয়; এই গানগুলির আবেদন চিরন্তন। সাধনপথে যাওয়ার কোনও দিন-সাল-তিথির প্রয়োজন হয় না। তাই এই রামপ্রসাদী গান-ও বিশেষ কালের সীমা অতিক্রম করে গেছে বাঙালির মানসপটে।

Comments

Popular posts from this blog

মাতৃরূপেণ—১২, 'অন্নপূর্ণে সদাপূর্ণে....'—শ্রীজীবশরণ দাস

কালীকথা-৩—পরমব্রহ্ম শবরূপ তাই — ড. অর্ঘ্য দীপ্ত কর

মাতৃরূপেণ—৫, বঙ্গ-মননে পরিবার-সমন্বিতা দুর্গা দর্শন—রাধাবিনোদ ঠাকুর