রবীন্দ্র-আলোকে ললিত ভারতী—সমীপেষু দাস

Image
  রবীন্দ্র-আলোকে ললিত ভারতী কাব্যসরস্বতী কোনো মন্দিরের বন্দিনী দেবতা নন                                                                                                       ( মধুমঞ্জরি, বনবাণী )                        রবীন্দ্রনাথ কাব্য ও সংগীতকে কখনওই পৃথক ব’লে ভাবতেন না। প্রথম জীবনের তাঁর কাব্যগুলির নামকরণ-ই তার যথাযথ প্রমাণ – সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল  ইত্যাদি। এমনকি যে কাব্যের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান; তা-ও গীতাঞ্জলি। তাঁর রচিত অসংখ্য কবিতা-ই গানের রূপ পেয়েছে। ব্যক্তিজীবনে তিনি তাঁর কাব্যরচনার প্রেয়সীরূপে পেয়েছিলেন তাঁর ‘নতুন বৌঠান’ তথা কাদম্বরী দেবী-কে। তিনি যখন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে আসেন; তখন বয়সে তিনি বালিকা। তাই সেই ছবিই পরবর্তীত...

কালীকথা-৬— খোয়াবনামা—প্রীতম বাগচী

  খোয়াবনামা


—প্রীতম বাগচী

ছাত্র, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।


আমাদের বাড়ির কাছ দিয়েই 'কল - কল ' শব্দ করে বয়ে গেছে পুণ্যতোয়া ভাগীরথী নদী । এই ভাগীরথীর আদিবৃত্তান্ত  নিয়ে আমাদের মফস্বলে ততটা আগ্রহী কেউ নন ,  তাই ভাগীরথী নামখানি লুপ্ত হয়ে সকলের কাছে  জলের মতো সহজ  ' গঙ্গা  ' নামটিই আপন হয়ে উঠেছে ।  

' উত্তরবাহিনী গঙ্গা জল চলেছে দিবানিশি ।  ' 

 আমাদের শহরের উত্তরদিকে  অর্থাৎ,  গঙ্গার ওইপারে যে ছোট্ট মফস্বলটি রয়েছে তার নাম ' হালিসহর '  ।  


প্রায় আড়াইশো বৎসর পূর্বে এই প্রাচীন জনপদ  ' হালিসহর  ' সুবে বাংলার অন্তর্ভূক্ত ছিল ।  নবদ্বীপ অধিপতি মহাগুণাকর রাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রায়শই হালিসহরের কাছারিবাড়িতে আসতেন ,  এই অঞ্চলেরই  দুইজন বিশিষ্ট কবিরত্নের  তরজা শুনতে ।  একজন ,  বৈষ্ণবকবি অযোধ্যানাথ গোস্বামী  ওরফে আজু গোঁসাই ,  অন্যজন শাক্ত গীতিকার রামপ্রসাদ সেন ।  রামপ্রসাদ এই অঞ্চলে ' কালীর বেটা রামপ্রসাদ  ' বলেই অধিক পরিচিত ছিলেন ।  

অন্যদিকে ,  মকসুদাবাদের  মসনদে তখন নবাব আলিবর্দির দৌহিত্র সিরাজ-উদ- দৌলা বসেছেন ।  অতি স্বাধীনচেতা সিরাজের বিচিত্র মর্জিতে বাংলার সামাজিক অবস্থা শোচনীয় ।  সুন্দরী রমণী অপহরণ ,  ধর্ষণ ,  গঙ্গায় মানুষ ডুবিয়ে মারার মতো নৃশংস কাজ ইত্যাদি নবাবের বিচিত্র মর্জির কিঞ্চিৎ উদাহরণ ।  এহেন নবাব সিরাজ পর্যন্ত রামপ্রসাদের গানে মুগ্ধ হয়ে মাঝেমধ্যেই তাঁকে তলব পাঠাতেন খাস মকসুদাবাদে ।  


 কোয়ারেন্টাইনের গৃহবন্দী অলসবেলায় মানসচক্ষে  ধূসর পৃথিবীর দিকে চাইলে সময়কাল এলোমেলো করে ধপ্ করে ওই আড়াইশো বছর আগেকার সময়ে গিয়ে পড়তে হয় ।  যেখানে সদ্য স্নান করে আসা রামপ্রসাদ তাঁর বাড়ির দাওয়ায় বসে আছেন ,  পাশে মাটির ভাঁড়ে রাখা কারণবারি নিয়ে । 

নীচু হয়ে তালিপত্রের উপর খসখস করে তখন তিনি ' কালীকীর্ত্তন ' লিখছেন  - 

' ভবজলধি - নিমগ্ন - রুগণ্  জনগন - বিমোচন - করণ - কারণ ভুবন - পালিকা কালিকার গোষ্ঠাদি লীলা বর্ণণ ।।  ' 

মাঝে মাঝে মাটির ভাঁড়টিতে চুমুক দিয়ে কারণসুধায় কন্ঠ ভিজিয়ে নিচ্ছেন ,  তারপর আবার লেখায় ডুব দিচ্ছেন ।  এই কালীকীর্ত্তন রচনার জন্য মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র স্বয়ং অনুরোধ করেছেন তাঁকে ,  তাই রামপ্রসাদ এখন মহাব্যস্ত ।  কাউকে খুব একটা কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছেন না ।  

তার উপর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় বেশ সম্মান - টম্মান পাওয়ায় তাঁর প্রতিপক্ষ আজু গোঁসাইয়েরও বেশ গোঁসা হয়েছে ।  বৈষ্ণব আজু গোঁসাইয়ের মুখে সর্বদা বৈষ্ণবজনোচিত কান এঁটো করা হাসি থাকলেও ,  সামনে মিষ্টি মিষ্টি কথা বললেও মনের ভিতর ঈর্ষার আগুন জ্বলছে ।  শুধু বৈষ্ণব আড়খেমটা গান নয় ,  লাগানিভাঙানিতেও গোঁসাই যে একজন সিদ্ধপুরুষ তা হালিসহরের সবাই জানে ।  গোসাঁইয়ের ভয়ে গ্রামের সকলে রামপ্রসাদ কে একপ্রকার একঘরে করেছে ,  তাতে রামপ্রসাদের বয়ে গেছে ।  

তবুও সন্ধ্যেবেলা কারণসিক্ত উদাত্ত কন্ঠে প্রসাদ যখন গান ধরেন ,   তখন সকলের মনে একটা স্বর্গীয় উদাসীনতা আসে ।  সকলে বলাবলি করে ,  প্রসাদ নিশ্চই কালীর বেটা নইলে এমন গান সে ক্যামন করে লেখে ?  এমন সুর সে কোথায় পায় ?  প্রসাদ সত্যিই কালীর বেটা !  

স্বয়ং গোঁসাই বাবাজী পর্যন্ত মনে মনে সন্দেহ করেন , প্রসাদ কি সত্যিই কালীর বেটা ?  

কালীকীর্ত্তনের গান শুনতে শুনতে বৈষ্ণব গোঁসাইয়ের দুই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে ।  হাতের কর্ত্তাল মাটিতে রেখে চোখ মুছে ,  হাতজোড় করে বসে থাকেন ।  তিনি স্পষ্ট দেখতে পান ,  রামপ্রসাদের ঘর আলো করে স্বয়ং মহামায়া আবির্ভূতা হয়েছেন আর প্রসাদ কোলের খোকাটির মতো মহামায়ার কোলে বসে আছেন ।  

ধন্য রামপ্রসাদ !  ধন্য মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র !  ধন্য এই হালিসহর ।  

গোঁসাই স্থির করেন আগামীকালই গ্রামের সকলের সামনে স্বীকার করবেন ,  রামপ্রসাদই মহারাজের দেওয়া  ' কবিরঞ্জন  ' উপাধির যোগ্য মানুষ ।  


আজ প্রায় আড়াইশ বৎসর পরে হালিসহরের দিক থেকে  গঙ্গার জোলো বাতাস  সেই সুর বহন করে নিয়ে আসে ।  সন্ধ্যের সময় যখন চারিদিকে শাঁখ বেজে ওঠে তখন হালিসহরের দিক থেকে শোনা যায় রাগিণী জংলার একতালা সুরের গান  - 

' রামপ্রসাদ বলে ভবের খেলায়,

যা হবার তাই হল ।

এখন সন্ধ্যাবেলায় কোলের ছেলে,

ঘরে নিয়ে চলো ॥  ' 


সেই গান শুনি আর মনে ভাবি ,  রামপ্রসাদ নিশ্চই কালীর বেটা  !  মা ... মা ...  মা ...     

 ***

Comments

Popular posts from this blog

মাতৃরূপেণ—১২, 'অন্নপূর্ণে সদাপূর্ণে....'—শ্রীজীবশরণ দাস

কালীকথা-৩—পরমব্রহ্ম শবরূপ তাই — ড. অর্ঘ্য দীপ্ত কর

মাতৃরূপেণ—৫, বঙ্গ-মননে পরিবার-সমন্বিতা দুর্গা দর্শন—রাধাবিনোদ ঠাকুর