কালীকথা-৬— খোয়াবনামা—প্রীতম বাগচী
- Get link
- X
- Other Apps
খোয়াবনামা
—প্রীতম বাগচী
ছাত্র, রবীন্দ্রভারতী বিশ্ববিদ্যালয়।
আমাদের বাড়ির কাছ দিয়েই 'কল - কল ' শব্দ করে বয়ে গেছে পুণ্যতোয়া ভাগীরথী নদী । এই ভাগীরথীর আদিবৃত্তান্ত নিয়ে আমাদের মফস্বলে ততটা আগ্রহী কেউ নন , তাই ভাগীরথী নামখানি লুপ্ত হয়ে সকলের কাছে জলের মতো সহজ ' গঙ্গা ' নামটিই আপন হয়ে উঠেছে ।
' উত্তরবাহিনী গঙ্গা জল চলেছে দিবানিশি । '
আমাদের শহরের উত্তরদিকে অর্থাৎ, গঙ্গার ওইপারে যে ছোট্ট মফস্বলটি রয়েছে তার নাম ' হালিসহর ' ।
প্রায় আড়াইশো বৎসর পূর্বে এই প্রাচীন জনপদ ' হালিসহর ' সুবে বাংলার অন্তর্ভূক্ত ছিল । নবদ্বীপ অধিপতি মহাগুণাকর রাজা কৃষ্ণচন্দ্র প্রায়শই হালিসহরের কাছারিবাড়িতে আসতেন , এই অঞ্চলেরই দুইজন বিশিষ্ট কবিরত্নের তরজা শুনতে । একজন , বৈষ্ণবকবি অযোধ্যানাথ গোস্বামী ওরফে আজু গোঁসাই , অন্যজন শাক্ত গীতিকার রামপ্রসাদ সেন । রামপ্রসাদ এই অঞ্চলে ' কালীর বেটা রামপ্রসাদ ' বলেই অধিক পরিচিত ছিলেন ।
অন্যদিকে , মকসুদাবাদের মসনদে তখন নবাব আলিবর্দির দৌহিত্র সিরাজ-উদ- দৌলা বসেছেন । অতি স্বাধীনচেতা সিরাজের বিচিত্র মর্জিতে বাংলার সামাজিক অবস্থা শোচনীয় । সুন্দরী রমণী অপহরণ , ধর্ষণ , গঙ্গায় মানুষ ডুবিয়ে মারার মতো নৃশংস কাজ ইত্যাদি নবাবের বিচিত্র মর্জির কিঞ্চিৎ উদাহরণ । এহেন নবাব সিরাজ পর্যন্ত রামপ্রসাদের গানে মুগ্ধ হয়ে মাঝেমধ্যেই তাঁকে তলব পাঠাতেন খাস মকসুদাবাদে ।
কোয়ারেন্টাইনের গৃহবন্দী অলসবেলায় মানসচক্ষে ধূসর পৃথিবীর দিকে চাইলে সময়কাল এলোমেলো করে ধপ্ করে ওই আড়াইশো বছর আগেকার সময়ে গিয়ে পড়তে হয় । যেখানে সদ্য স্নান করে আসা রামপ্রসাদ তাঁর বাড়ির দাওয়ায় বসে আছেন , পাশে মাটির ভাঁড়ে রাখা কারণবারি নিয়ে ।
নীচু হয়ে তালিপত্রের উপর খসখস করে তখন তিনি ' কালীকীর্ত্তন ' লিখছেন -
' ভবজলধি - নিমগ্ন - রুগণ্ জনগন - বিমোচন - করণ - কারণ ভুবন - পালিকা কালিকার গোষ্ঠাদি লীলা বর্ণণ ।। '
মাঝে মাঝে মাটির ভাঁড়টিতে চুমুক দিয়ে কারণসুধায় কন্ঠ ভিজিয়ে নিচ্ছেন , তারপর আবার লেখায় ডুব দিচ্ছেন । এই কালীকীর্ত্তন রচনার জন্য মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র স্বয়ং অনুরোধ করেছেন তাঁকে , তাই রামপ্রসাদ এখন মহাব্যস্ত । কাউকে খুব একটা কাছে ঘেঁষতে দিচ্ছেন না ।
তার উপর মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্রের সভায় বেশ সম্মান - টম্মান পাওয়ায় তাঁর প্রতিপক্ষ আজু গোঁসাইয়েরও বেশ গোঁসা হয়েছে । বৈষ্ণব আজু গোঁসাইয়ের মুখে সর্বদা বৈষ্ণবজনোচিত কান এঁটো করা হাসি থাকলেও , সামনে মিষ্টি মিষ্টি কথা বললেও মনের ভিতর ঈর্ষার আগুন জ্বলছে । শুধু বৈষ্ণব আড়খেমটা গান নয় , লাগানিভাঙানিতেও গোঁসাই যে একজন সিদ্ধপুরুষ তা হালিসহরের সবাই জানে । গোসাঁইয়ের ভয়ে গ্রামের সকলে রামপ্রসাদ কে একপ্রকার একঘরে করেছে , তাতে রামপ্রসাদের বয়ে গেছে ।
তবুও সন্ধ্যেবেলা কারণসিক্ত উদাত্ত কন্ঠে প্রসাদ যখন গান ধরেন , তখন সকলের মনে একটা স্বর্গীয় উদাসীনতা আসে । সকলে বলাবলি করে , প্রসাদ নিশ্চই কালীর বেটা নইলে এমন গান সে ক্যামন করে লেখে ? এমন সুর সে কোথায় পায় ? প্রসাদ সত্যিই কালীর বেটা !
স্বয়ং গোঁসাই বাবাজী পর্যন্ত মনে মনে সন্দেহ করেন , প্রসাদ কি সত্যিই কালীর বেটা ?
কালীকীর্ত্তনের গান শুনতে শুনতে বৈষ্ণব গোঁসাইয়ের দুই চোখ ঝাপসা হয়ে আসে । হাতের কর্ত্তাল মাটিতে রেখে চোখ মুছে , হাতজোড় করে বসে থাকেন । তিনি স্পষ্ট দেখতে পান , রামপ্রসাদের ঘর আলো করে স্বয়ং মহামায়া আবির্ভূতা হয়েছেন আর প্রসাদ কোলের খোকাটির মতো মহামায়ার কোলে বসে আছেন ।
ধন্য রামপ্রসাদ ! ধন্য মহারাজ কৃষ্ণচন্দ্র ! ধন্য এই হালিসহর ।
গোঁসাই স্থির করেন আগামীকালই গ্রামের সকলের সামনে স্বীকার করবেন , রামপ্রসাদই মহারাজের দেওয়া ' কবিরঞ্জন ' উপাধির যোগ্য মানুষ ।
আজ প্রায় আড়াইশ বৎসর পরে হালিসহরের দিক থেকে গঙ্গার জোলো বাতাস সেই সুর বহন করে নিয়ে আসে । সন্ধ্যের সময় যখন চারিদিকে শাঁখ বেজে ওঠে তখন হালিসহরের দিক থেকে শোনা যায় রাগিণী জংলার একতালা সুরের গান -
' রামপ্রসাদ বলে ভবের খেলায়,
যা হবার তাই হল ।
এখন সন্ধ্যাবেলায় কোলের ছেলে,
ঘরে নিয়ে চলো ॥ '
সেই গান শুনি আর মনে ভাবি , রামপ্রসাদ নিশ্চই কালীর বেটা ! মা ... মা ... মা ...
***
- Get link
- X
- Other Apps
Comments
Post a Comment