রবীন্দ্র-আলোকে ললিত ভারতী—সমীপেষু দাস

Image
  রবীন্দ্র-আলোকে ললিত ভারতী কাব্যসরস্বতী কোনো মন্দিরের বন্দিনী দেবতা নন                                                                                                       ( মধুমঞ্জরি, বনবাণী )                        রবীন্দ্রনাথ কাব্য ও সংগীতকে কখনওই পৃথক ব’লে ভাবতেন না। প্রথম জীবনের তাঁর কাব্যগুলির নামকরণ-ই তার যথাযথ প্রমাণ – সন্ধ্যাসংগীত, প্রভাতসংগীত, ছবি ও গান, কড়ি ও কোমল  ইত্যাদি। এমনকি যে কাব্যের জন্য তিনি নোবেল পুরস্কার পান; তা-ও গীতাঞ্জলি। তাঁর রচিত অসংখ্য কবিতা-ই গানের রূপ পেয়েছে। ব্যক্তিজীবনে তিনি তাঁর কাব্যরচনার প্রেয়সীরূপে পেয়েছিলেন তাঁর ‘নতুন বৌঠান’ তথা কাদম্বরী দেবী-কে। তিনি যখন জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়িতে আসেন; তখন বয়সে তিনি বালিকা। তাই সেই ছবিই পরবর্তীত...

ছট্ পূজার বিশেষ রচনা—সূর্য- বৈদিক আঙ্গিকে—বুদ্ধদেব ঘোষ

  সূর্য- বৈদিক আঙ্গিকে


—বুদ্ধদেব ঘোষ

 ছাত্র, রামকৃষ্ণ মিশন বিবেকানন্দ এড‍্যুকেশনাল্ অ্যান্ড্ রিসার্চ্ ইন্স্টিটিউট্, বেলুড় মঠ


সূর্য উপাসনা ভারতীয় সমাজে ও পরম্পরায় এক সর্বসময়ের অবিচ্ছেদ্য বিষয়। পরমকরূণাময়ী শ্রুতি সূর্য্যের মাহাত্ম্যকীর্তন করেছেন সতত- সূর্য় আত্মা জগতস্তস্থুশ্চ। সূর্যের গতিপথে বিভিন্ন সময়ের তার অবস্থান চিহ্নিত করে তারই উপাসনা আমাদের পরম্পরায় সন্ধ্যা বন্দনা নামে গৃহীত। বৈদিক ঋষি সেই গগনরাজ সূর্য্যের অত্যাশ্চর্য্য রূপ ও বিস্ময়কর শক্তিকে অনুধাবন করে তার স্তুতি গেয়ে উঠেছেন বারংবার। ভারতেরও বিখ্যাত সূর্য্যমন্দিরগুলিও সেই প্রাচীন পরম্পরার এক উজ্জ্বল নিদর্শন। এই সূর্য্যদেব হল তেজের স্বরূপ এবং জীবকূলের প্রত্যক্ষ দেবতা যিনি আরোগ্য কারীও বটে, তিনিই আবার পুরাণে বর্ণিত হবেন জ্ঞানদাতা হিসাবে। ইশোপনিষদে দেখতে পাই অগ্নে নয়ে সুপথা রায়ে অস্মান্ ইত্যাদি মন্ত্রে দক্ষিণমার্গে গমনকারীর সূর্যকে নিজ তেজ সংবরণ করে তত্পশ্চাতে রহস্যময়ী অমৃতলোককে দেখার আকুতি। আমরা সূর্য্যকে- বিবস্বান, রবি, আদিত্য, পুত্র, পুষা, দিবাকর, সবিতৃ, মিত্র, ভানু, ভাস্কর, গ্রহপতি ইত্যাদি নামে জানি। এর মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয় নামটি অবশ্যই রবি যেবারের অধিপতি তিনি নিজেই। এছাড়াও যদিও আদিত্য শব্দটি বস্তুতঃ সকল দেবতাকে বোঝানো হয়, (অদিতির পুত্র) তাও সূর্য্য অর্থেই তা প্রসিদ্ধ বেশি। ঋগ্বেদের দ্বিতীয় মন্ডলে ২৭তম সূক্তে ছয় জন আদিত্য বা দেবতার নাম পাওয়া যায়। কশ্যপ-এর ঔরসে অদিতি'র গর্ভে এঁর জন্ম হয়েছিল। দ্বাদশমূর্তি রূপে সূর্য দ্বাদশ আদিত্য-এ বিভাজিত। দিবাকর, ভাস্কর ইত্যাদি নামগুলি কিন্তু সম্পূর্ণ তার কার্য্যকে ইঙ্গিত করেই এসেছে। পুরাণে সূর্য্যের বিষয়ে যেমন বিভিন্ন কাহিনী পাওয়া বেদে তেমন কাহিনীর সূত্রপাত না হলেও সেখানে সূর্য্যের এক অভিনব স্ততি আমরা পাই। আমরা এই রচনার পরবর্তী অংশে সেই স্তুতিটি নিয়ে একটু আলোচনা করব। দ্বিতীয় লাইনের উদ্ধৃতিটিও সেখান থেকেই নেওয়া। আমাদের আলোচ্যমান স্তুতিটি ঋগ্বেদস্থ ও সূর্য্যসূক্ত নামে সমধিক পরিচিত। এই মন্ত্রগুলির দ্রষ্টা কুত্স বা আঙ্গিরস, ত্রিষ্টুপাদি ছন্দ ও ধৈবত স্বর। এর প্রথম মন্ত্র- চিত্রং দেৱানামুদগাদনীকং চক্ষুর্মিত্রস্য ৱরুণস্যাগ্নেঃ। আপ্রা দ্যাৱাপৃথিৱী অন্তরিক্ষং সূর্য় আত্মা জগতস্তুস্থুষশ্চ।। (১.১১৫.০১) এ স্তুতি যে ঘরের অন্দরে লেখা কোনো প্রশস্তিবাক্য নয় তা এর প্রথম বাক্যেই স্পষ্ট। ঋষি দিনের প্রথম আকাশে দেখেছেন উদীয়নান উজ্জ্বল সূর্যকে তাঁর আভায় বিভাবিত সমস্ত জগন্মন্ডল। ঋষির চোখে তাই যেন রাশি রাশি দেবগন উদিত হচ্ছেন সূর্যের রূপে। প্রত্যেকটি কিরণই তার এমন তাত্পর্য্যপূর্ণ যে কিরণগুলিই এক এক দেবতার প্রতিরূপ। মিত্র বরূণ অগ্নি এদের চক্ষুও তো বস্তুতঃ এই সূর্য্যই। বস্তুতঃ মিত্র সূর্যদেবতাই। বেদে আলোর দেবতা মিত্র ও জলের দেবতা বরুণ একত্রে মিত্রাবরুণ নামে সম্বোধিত হতে দেখা যায়। বরুণ অর্থ আবৃত। বৈদিকরা আকাশকে একটি বিশাল সমুদ্র হিসাবে বিবেচনা করতেন। আবার আকাশ ও সমুদ্রের মিলনস্থানকে বরুণের অবস্থান হিসাবে বিবেচনা করতেন। বরুণের ক্ষেত্র থেকে সূর্যের উদয় হয় বলে- সূর্যকে বরুণের চক্ষু বিবেচনা করা হত। সূর্যকে অগ্নির চক্ষু বলাতে অনেক সময় কিন্তু তার ভৌতিক স্বরূপের বিষয়ে দ্যোতনা খুঁজে পাওয়া যায়।  এরপর দ্বিতীয় লাইনে দ্যুলোক পৃথ্বী ও অন্তরিক্ষের তেজের পরিপূরক হিসাবে তাঁকে দেখানো হয়েছে। ইনি সকলের প্রেরক ও পরমাত্মা  এও বলা হয়েছে। প্রশ্নোপনিষদেও আমরা পিপ্পলাদমুনির কাছে শুনি প্রাণস্বরূপ এই আদিত্য। সেইখানে আবার একটি স্তুতিও পাই প্রাসঙ্গিক মনে করে এখানে উদ্ধৃত হল- বিশ্ৱরূপং হরিণং জাতৱেদসং পরায়ণং জ্যোতিরেকং তপন্তম্। সহস্ররশ্মিঃ শতধা ৱর্তমানঃ প্রাণঃ প্রজানামুদয়ত্যেষ সূর্যঃ।। (১.৮) এই মন্ত্রটিও কিন্তু উদীয়মানসূর্যের রূপ দেখে স্তুত হয়েছে। এখানেও তিনি সহস্ররশ্মি, জাতবেদা, বিশ্বরূপ সর্বোপরি সকল প্রজা বা প্রাণিবর্গের প্রাণস্বরূপ।সূর্যো দেৱীমুষসং রোচমানাং মর্ত্যো ন য়োষামভ্যেতি পশ্চাত্। য়ত্রা নরো দেৱয়ন্তো য়ুগানি বিতন্ৱতে প্রতি ভদ্রায় ভদ্রম্।।- এই আলোচ্যমান সূক্তটির দ্বিতীয় মন্ত্র। এখানে সূর্য সুন্দরী যুবতীর অনুগমনকারী পুরুষ যেন। যিনি ঊষাদেবীর পিছন পিছন আসছেন। তাঁর আগমনে আবার কর্মনিষ্ঠ মনুষ্য কর্তব্য কর্ম সম্পাদন করতে উদ্গ্রীব হচ্ছে। কল্যাণরূপ সূর্যের আরাধনা আসলে যেন দিনের নিত্যকর্তব্যের পালনের মাধ্যমেই হয়, ও আমাদের প্রত্যেকদিনের কাজকর্ম যেন সেই সূর্যের প্রকাশিত হওয়াকে সার্থক করে আমাদের জীবনে বয়ে নিয়ে আসে কল্যাণ। ভদ্র অশ্ৱা হরিতঃ সূর্য়স্য চিত্রা এতগ্ৱা অনুমাদ্যাসঃ। নমস্যন্তো দিৱ আ পৃষ্ঠমস্থুঃ পরি দ্যাৱাপৃথিৱী য়ন্তি সদ্যঃ।। ৩ এই মন্ত্রে আমাদের বহুকালে থেকে শুনে আসা সেই সপ্তাশ্বযুক্ত রথে ভ্রমণকারী দেবতার চিত্রের মূল যেন রয়েছে। এখানে সূর্যের রশ্মিসমূহ যেন ঘোড়া, কারণ তারা ক্ষিপ্রগতি অশ্বের মতো সর্বত্র পৌছাতে পারে। এরকম কিরণযুক্ত দেবতাটি প্রতিদিন নিজ পথে ঠিক চলতে থাকেন, তাই এমন নিষ্ঠার প্রতিভূ অপরিবর্তনীয় উদ্যোগযুক্ত দেবতা তাই আমাদের অবশ্য বন্দনীয়- অর্চনীয়। সকলের প্রেরণাদায়ক ইনি থাকেন দ্যুলোকে এবং দিনে এই পরিভ্রমন করছেন। তত্ সূর্য়স্য দেৱত্ৱং তন্মহিত্ৱং মধ্যা মধ্যা কর্তোৱিততং সং জভার। য়দেদয়ুক্ত হরিতঃ সধস্থাদাদ্রাত্রী ৱাসস্তুনুতে সিমস্মৈ।। ৪ সূর্য এই মন্ত্রে সর্বান্তর্যামী, তিনি গমনের সময় নিজের কিরণসকলকে নিজের মধ্যে আত্মস্থ করে নেন। তিনি কিন্তু অপরিসমাপ্তকার্যের কথা ভাবেন না। পরের দিন তার পুনরায় শুভারম্ভ করেন কিন্তু সময়জ্ঞান যেন তার অপরিবর্তনীয় তাই ঠিক সময়ে অস্তাচলে যান।- এখানেই তাঁর মহত্ব। তিনি প্রাজ্ঞ। অস্তাচল আসলে একটি পাহাড়, প্রচলিত বিশ্বস অনুযায়ী সেই পর্বতের পিছনেই সূর্য থাকেন রাত্রে। অন্ধকারের আবরণে এরপর সবকিছু মুড়ে নেন রাত্রি। পঞ্চম মন্ত্রে পাই- তন্মিত্রস্য বরূণস্যাভিচক্ষে সূর্য়ো রূপং কৃণুতে দ্যৌরুপস্থে। অনন্তমন্যদ্ রুশদস্য পাজঃ কৃষ্মমন্যদ্ধরিতঃ সম্ভরন্তি।।৫ সকলের প্রেরণা হিসেবে সূর্য প্রাতঃকালে সমগ্র সৃষ্টিকে প্রকাশ করার জন্যই এখানে প্রকাশিত হন, তা বলা হল। এছাড়াও বলা হল রসভোজী (রস কিন্তু আসলে আর্দ্রতা) তার সব রশ্মিসকল অন্ধকারনিবারণে সমর্থ। অদ্যা দেৱা উদিতা সূর্য়স্য নিরংহসঃ পিপৃতা নিরৱদ্যাত্। তন্নো মিত্রো ৱরুণো মামহন্তামদিতিঃ সিন্ধুঃ পৃথিবী উত দ্যৌঃ।। এই সূক্তের অন্তিম এই মন্ত্রে প্রকাশমান সূর্য রশ্মি সূর্যোদয়ের সময়ের নিজ কিরণ ছড়িয়ে আমাদের সকলকে পাপসকল থেকে রক্ষা করার প্রার্থনা জানানো হচ্ছে। কারণ তিনি তো পূষা সর্বোত্তম পাপহরণকারী। এখানে শুধুই পাপ থেকে নয় বরং যা কিছু নিন্দিত, গর্হিত, দুঃখময় সব কিছু থেকেই আমাদের রক্ষা করুন। এই নেতিবাচকতা সংশ্লিষ্ট প্রার্থনার পর বলা হচ্ছে ইতিবাচক কথা, যে- যা কিছু আমরা বলেছি (বলি) মিত্র, বরুণ, অদিতি, সিন্ধু, পৃথ্বী ও দ্যৌলোকের অধিষ্ঠাতৃ দেবতা তার আদর অনুমোদন করুন, অর্থাত্ সূর্যকেই বলা হচ্ছে যে এই দেবতারাও যেন আমাদের প্রার্থনা শোনেন- আমাদের রক্ষা করেন। এইভাবেই সূর্য্যের বিভিন্ন রূপ ও স্বরূপের স্তুতি, বর্ণনা ও প্রার্থনা হয়েছে বৈদিকসাহিত্যে। সেই সূর্য প্রাকৃতিক নক্ষত্র বা শক্তি থেকে হয়ে উঠেছেন প্রাণের দেবতা সর্বশক্তির আধার পরমাত্মা। আধিভৌতিক থেকে আধিদৈবিক স্তরের এই রূপায়ণ ও প্রাকৃতিক উজ্জ্বলতার পিছনে এমন দর্শণের আবির্ভাবই যুগে যুগে তাই বৈদিকসাহিত্যের পাঠকদের করেছেন মুগ্ধ। শ্রুতির অপৌরূষেয়তা সমাদরকারীদের কাছে তো এ নিত্যসত্যতার বন্দনা ও যে কারুর কাছেই আসলে এ পরম মর্মের থেকে উত্সারিত আকুতি যা সর্বভূতে সত্য, ঈশ্বর ও সুন্দরের দর্শনের অন্যতম মূল।।

------------------------------------------------------------------------------------------

Comments

Post a Comment

Popular posts from this blog

মাতৃরূপেণ—১২, 'অন্নপূর্ণে সদাপূর্ণে....'—শ্রীজীবশরণ দাস

কালীকথা-৩—পরমব্রহ্ম শবরূপ তাই — ড. অর্ঘ্য দীপ্ত কর

মাতৃরূপেণ—৫, বঙ্গ-মননে পরিবার-সমন্বিতা দুর্গা দর্শন—রাধাবিনোদ ঠাকুর